তারিখ দিন ক্ষণ জয়ন্তী, এ সব নিয়ে প্রায়শই নানা জটিলতা দেখা যায়। সম্প্রতি এমনই একটি জটিলতা তৈরি হয়েছে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির শতবর্ষ নিয়ে। পার্টির তরফে শতবর্ষের বিষয়টি স্বীকৃত হয়েছে, দেশের বহু স্থানে তা পালিতও হচ্ছে। কিন্তু অনেকের মতে, প্রকৃত শতবর্ষের কাল কেটে গিয়েছে ২০২০ সালে। মীমাংসার্থে এক বার ইতিহাসের দিকে ঘুরে তাকানো ভাল। আসলে একটি দলের প্রকৃত সূচনা কোন মুহূর্তটিকে বলা হবে, সমস্যা সেখানেই। ১৯২০ সালের ১৭ অক্টোবর মানবেন্দ্রনাথ রায় যখন সুদূর তাসখন্দে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠা করেন, সেটিই কি দলের প্রকৃত জন্মলগ্ন? না কি, ১৯২৫ সালে কানপুরের সম্মেলনে মস্কো ও লন্ডন থেকে শিক্ষাপ্রাপ্ত ভারতীয় কমিউনিস্ট এবং এ দেশের সমভাবাপন্ন মানুষজনের উদ্যোগে কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়ার যাত্রারম্ভই তার প্রকৃত জন্মক্ষণ? স্পষ্টতই, দেশের মধ্যে দলের অবয়ব নির্মাণ, যে দল পরবর্তী কালে ভারতীয় রাজনীতির অঙ্গীভূত হবে— এই কারণেই ১৯২৫ সালের গুরুত্ব অনস্বীকার্য। এও উল্লেখ্য যে, এই সময়েই ব্রিটিশ রাজও বলশেভিক মতবাদ ছড়ানো বিষয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠে: ১৯২৪-২৫ সালে কানপুর ষড়যন্ত্র মামলায় বহু বামপন্থীকে জড়িয়ে ফেলে। নতুন দলে এসে যোগ দেন প্রাক্তন বিপ্লবীরা। এক দিকে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের জন্ম, অন্য দিকে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির ভারতের মাটিতে রাজনৈতিক যাত্রারম্ভ— সব মিলিয়ে ১৯২৫ সালটি ছিল নিতান্তই ঐতিহাসিক।
জন্মক্ষণের বিতর্কটি সিপিআই-এর ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অন্য একটি কারণেও। ভারতের যে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন, তার সঙ্গে কমিউনিস্টদের সম্পর্ক কী হবে, এ নিয়ে প্রথম থেকে মতভেদ প্রবল। প্রথম গোষ্ঠীর প্রতিষ্ঠাতা মানবেন্দ্রনাথ রায়ের সঙ্গে এ নিয়ে লেনিনের বিরোধ বহুজ্ঞাত। শোনা যায়, ১৯২০ সালে কমিনটার্নে মানবেন্দ্রনাথ এ বিষয়ে যে বক্তব্য পেশ করেন, লেনিন নিজ হাতে তা পরিবর্তন করেন। ১৯২২ সালের শেষে কমিনটার্নের দিক থেকেই নির্দেশ আসে যে উপনিবেশের কমিউনিস্টরা যেন জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে যোগ দেন। ১৯২৪ সালে তাঁদের বলা হয় দল গঠন করতে, এবং সমাজবাদী দৃষ্টিভঙ্গি অটুট রেখে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতায় মনোযোগী হতে। ১৯২৫ সালে সিপিআই-এর জন্মকে এই সূত্রে ফিরে দেখা যায়। অতঃপর ডাঙ্গে বা সিঙ্গারাভেলুর মতো নেতারা দেশের ট্রেড ইউনিয়ন দখল রাজনীতিতে উদ্যোগী হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বৃহত্তর আন্দোলনের সঙ্গে তাকে কী ভাবে যুক্ত করা যায় সেই চিন্তাও শুরু করেন। ব্রিটিশ রাজের বিভিন্ন প্রশাসনিক নথিপত্রে উঠে আসে জাতীয়তাবাদী, বিপ্লবী ও কমিউনিস্টদের মধ্যে রাজনৈতিক আদানপ্রদান বিষয়ে গভীর উদ্বেগ। এ বিষয়ে বাংলায় দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ ও স্বরাজ্য পার্টির ভূমিকা আলাদা ভাবে উল্লেখ্য। দেশবন্ধুর সহকর্মী হেমন্ত সরকার যে লেবার স্বরাজ পার্টি স্থাপন করেন, মানবেন্দ্রনাথ রায় তার প্রতি উদাত্ত সমর্থন জানান। যেন একটি বৃহৎ রাজনৈতিক মঞ্চের সম্ভাবনা তৈরি হয়ে উঠছিল পরাধীন ভারতে। পরবর্তী দশকগুলিতে নানা কারণে সেই সম্ভাবনার আলোক বিনষ্ট হয়— যা নিয়ে ব্রিটিশ রাজের উৎফুল্লতা সহজেই অনুমেয়।
নিজেদের ভাবধারা দ্রুত ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য ১৯২০-র দশকে এই দল বেশ কিছু পত্রিকা প্রকাশ শুরু করে। সমাজতান্ত্রিক ভাবধারার সঙ্গে জাতীয়তাবাদী ভাব প্রচারেও এগুলি মনোযোগী ছিল। মুজফ্ফর আহমদের নবযুগ, কাজী নজরুল ইসলামের ধূমকেতু, এবং পরে লাঙল ও গণবাণী যে রাজনীতি ধারা তৈরি করে, সচেতন ভাবেই তাকে জাতীয়তাবাদের বামপন্থী অক্ষ নাম দেওয়া যায়। জওহরলাল নেহরু, সিঙ্গারাভেলু, ডাঙ্গে প্রমুখ নেতা শ্রমিক আন্দোলনকে হাতিয়ার করে জাতীয় আন্দোলনে গতি আনার কথা বলেন। শতবর্ষ আগের সময়টিকে ফিরে ভাবলে বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, মূলস্রোতের জাতীয়তাবাদের থেকে আদর্শ-পার্থক্য সত্ত্বেও তখনকার কমিউনিস্ট ও সমাজবাদী নেতারা ভাবছিলেন যে, উপনিবেশের বাস্তবে কী ভাবে তাঁদের আন্দোলন চালাতে হবে। প্রসঙ্গত, এমন কোনও ভাবনা কিন্তু রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ করেনি। পরবর্তী কালে বামপন্থী রাজনীতি জাতীয়তাবাদী আন্দোলন থেকে ক্রমশ সরে যায়। ক্রমেই বোঝা যায়, রাজনীতির কোন তরঙ্গ-আবর্তে কেমন করে নিজেদের ভাসাতে হবে, সেই বিবেচনা ভারতীয় বাম রাজনীতির চরিত্রগত নয়। তবে একশো বছর আগে তার কিছু ব্যত্যয় ঘটেছিল, ফলত, সাময়িক ভাবে হলেও জ্বলে উঠেছিল নানা সম্ভাবনার আলো।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)