E-Paper

আলো-বিলোপ

মানুষের বিদ্বেষ কোনও নতুন অনুভূতি নয়, কিন্তু সেই বিদ্বেষের সাহসী খোলামেলা উদ্‌যাপন এবং গৌরবায়ন— আধুনিক বিশ্বে এ এক নতুন ঘটনা বটে।

শেষ আপডেট: ২৮ ডিসেম্বর ২০২৫ ০৭:১৫

জগতের শত শত/ অসমাপ্ত কথা যত/ অকালের বিচ্ছিন্ন মুকুল/ অকালের জীবনগুলা/ অখ্যাত কীর্তির ধুলা/ কত ভাব, কত ভয় ভুল। রবীন্দ্রপঙ্‌ক্তি-সূত্রে, বছরের শেষে মনে হয়, কত শত অকালের বিচ্ছিন্ন মুকুল নিয়ে গেল এই বিলীয়মান বছর। কিছু সাম্প্রতিক সংবাদ নতুন করে এই ভাবনা চারিয়ে দিয়ে যায়, বিশেষত যখন শোনা যায় কেবল নিজের ভাষায় কথা বলার ‘দোষ’-এ কত প্রাণকে অকালে ঝরে যেতে হল। ২০২৫ সালের অগণিত এমন ঘটনার মধ্যে ডিসেম্বর-শেষে যুক্ত হল আরও দু’টি প্রাণ: এক জন কেরলে কর্মরত ছত্তীসগঢ়ের শ্রমিক, এবং আর এক জন ওড়িশায় কর্মরত পশ্চিমবঙ্গের শ্রমিক। দুই জনের বিরুদ্ধেই পার্শ্ববর্তী জনতা ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে তাঁদের নির্যাতন ও নিধন করেন, কারণ ধরে নেওয়া হয় তাঁরা বাংলাদেশি, এবং/সুতরাং মুসলমান ধর্মাবলম্বী, ফলে নিধনযোগ্য। কেরলের ঘটনায়, নিধনের আগে নির্যাতন নাকি এমনই মাত্রায় ছিল যে অটপ্সি-কারী চিকিৎসক স্তম্ভিত হয়ে জানিয়েছেন, এমন শারীরিক অত্যাচার অভাবনীয়, অদৃষ্টপূর্ব। তিনি রীতিমতো অসুস্থ হয়ে পড়েন ঘটনার অভিঘাতে। এই চিকিৎসকও ভারতীয়, এই আক্রমণকারীরাও ভারতীয়। অপরিচিতকে সম্পূর্ণ অকারণে ছিন্নভিন্ন করে অপরিসীম যন্ত্রণা দিয়ে মৃত্যুপথে পাঠানোর মতো মানুষও কম নেই, আবার অপরিচিতের জন্য সমবেদনা, এমনকি শোক, অনুভব করার মানুষও কম নেই। কোন দল বাড়ছে, কোন দল কমছে? সাম্প্রতিক কালের সংবাদ বলবে, আক্রমণ ও হিংসার কাহিনিই ক্রমবর্ধমান, ও তার পিছনের প্রশ্রয়দাতা বিভীষিকাময় রাজনীতির বাড়বাড়ন্ত অপরিসীম। বৎসরান্তের অবকাশে জিজ্ঞাসা উপস্থিত হয়, এই যে আক্রমণের ভারত ও সমবেদনার ভারত, বর্তমান দেশ, এবং ভবিষ্যৎ দেশ, কোনটিকে বেছে নেবে? সেই নির্বাচন কি এই সব হিংসার ঘটনার উপর এক চুলও নির্ভর করে? হিংসার সংবাদ থেকে কেউ কি কখনও অ-হিংসার প্রতিজ্ঞা নেয়?

উত্তর ভাবতে গেলে মনে হয়, বরং ঘটনাটি বিপরীত। হিংসা বস্তুটি ক্রমে এমনই গা-সওয়া হয়ে উঠছে যে, যে-কোনও রকমের বিদ্বেষ কিংবা ব্যর্থতাবোধ নিমেষে হিংসায় পরিণত হওয়া এখন ক্রমশই নতুন ‘স্বাভাবিক’-এ পরিণত। বুঝতে অসুবিধা নেই, যতই চলবে এই স্বাভাবিকীকরণ, ততই স্পষ্ট হবে কোন দল জিতছে, আর কোন দেশ হারছে, কিংবা না হারলেও নীরবতায় বিলীন হচ্ছে। কিছু দিন আগেও কি ভাবা গিয়েছিল, চিকেন প্যাটি বিক্রি করার ‘অপরাধ’-এ কলকাতার কেন্দ্রস্থলে কোনও ব্যক্তিকে এমন ভাবে গণপ্রহৃত হতে হবে? এবং তার পর অন্যতম রাজনৈতিক দলের প্রধান বাঙালি নেতা সেই গণপ্রহারের নায়ককে সর্বসমক্ষে পুরস্কারে বরণ করবেন? মানুষের বিদ্বেষ কোনও নতুন অনুভূতি নয়, কিন্তু সেই বিদ্বেষের সাহসী খোলামেলা উদ্‌যাপন এবং গৌরবায়ন— আধুনিক বিশ্বে এ এক নতুন ঘটনা বটে।

বিদ্বেষ তো কেবল ব্যক্তির বা গোষ্ঠীর নয়, বিদ্বেষ যেন আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থা থেকে সতত উৎসারিত। বছরের শেষ দেড় মাস ধরে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে শোনা গেল একের পর এক আত্মহননের সংবাদ, যার পিছনে প্রধান কারণ— ভোটার তালিকা সংশোধন-সূত্রে নাগরিকতা হরণের আশঙ্কা ও আতঙ্ক। আশ্চর্য হয়ে দেখতে হয়, সরকারি কাজের ঠেলায় সাধারণ মানুষের এই অসীম ভয় ও বেদনা আত্মহনন অবধি পৌঁছে যায়, তবু সরকারের কোনও হেলদোল থাকে না, তাঁরা নিষ্কম্প নির্ভয়। সরকারি নেতা বা কর্তা এক বারের জন্যও সন্তপ্ত পরিজনের কাছে গিয়ে দাঁড়ান না, কারণ তাঁদের নজরে এ সবই এখন ‘কোল্যাটারাল ড্যামেজ’, মানুষের ভোট নিয়ে তাঁদের কারবার, মানুষের জীবন নিয়ে ভাবার সময় নেই। কয়েক দিন আগে বাংলাদেশে দীপু দাস নামক এক অখ্যাত সাধারণ মানুষের ভয়ঙ্কর রাজনৈতিক হত্যা বিশ্বব্যাপী আতঙ্কের শিহরন বইয়ে দিল, কিন্তু সেই রাজনীতির সমর্থক/সহায়ক সে দেশের সরকার ক্ষমাপ্রার্থনার ধার দিয়েও গেল না। ভাবটা যেন, এ সব তো হতেই পারে, আশ্চর্য কী। তেইশ মাসে গাজ়ায় ইজ়রায়েলের বোমাবর্ষণে প্রায় তেইশ হাজার শিশু নিহত হয়েছে, কিন্তু তাতে ইজ়রায়েলের দুঃখপ্রকাশ দূরস্থান, উল্টে সে দেশের নেতারা সগৌরবে জানিয়েছেন, কোনও শিশু বেঁচে থাকলেই বরং বিপদ। প্রকৃতই, ব্যক্তিগত, গোষ্ঠীগত, সমষ্টিগত বিদ্বেষের এই যে সাড়ম্বর উদ্‌যাপন, এই আবহে ছোট ছোট জীবনের ব্যথাবেদনা, পরাজয় বা প্রস্থান আজ সম্পূর্ণ মূল্যহীন। নতুন বছর আসবে যাবে আবার আসবে, মানবসমাজে মানবিকতা নামক গুণটি বিসর্জনের ধারাবাহিক পালা সম্ভবত চলতেই থাকবে।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Communalism Fundamentalism

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy