সন্তানের জন্ম দিতে গিয়ে নাবালিকার মৃত্যু— এই লজ্জা থেকে যেন মুক্তি নেই রাজ্যবাসীর। উন্নয়নের যত প্রমাণ পেশ করছে রাজ্য সরকার, তার বিপরীতে সাক্ষ্য দিচ্ছে নাবালিকা বিবাহ, নাবালিকার গর্ভধারণ এবং প্রসূতিমৃত্যুর পরিসংখ্যান। কেবল কয়েকটি ‘সঙ্কটাপন্ন’ ব্লকে আবদ্ধ না থেকে দ্রুত নানা জেলায় ছড়িয়েছে এই ভয়ঙ্কর প্রবণতা। গত বছর স্বাস্থ্য দফতরের সমীক্ষাতেই দেখা গিয়েছিল, বিভিন্ন জেলার ১৩০টি ব্লকে মোট প্রসূতির ২০-২৯ শতাংশ নাবালিকা। আরও ২৫টি ব্লক চিহ্নিত হয়েছিল, যেখানে মোট প্রসূতির ৩০ শতাংশেরও বেশি নাবালিকা। মালদহ, মুর্শিদাবাদ, পশ্চিম মেদিনীপুর জেলাগুলি নাবালিকা বিবাহ ও প্রসবের উচ্চহারের জন্য আগে থেকেই পরিচিত ছিল। গত কয়েক বছর এই হার বেড়েছে বীরভূম, বসিরহাট, বিষ্ণুপুর, পূর্ব বর্ধমান, রামপুরহাটের মতো জেলা ও স্বাস্থ্য জেলাগুলিতেও। ২০২৩-২৪ এবং ২০২৪-২৫, দু’টি অর্থবর্ষে মোট প্রসূতির মধ্যে নাবালিকা প্রসূতির হার ১৫ শতাংশের নীচে নামেনি। নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না নাবালিকা প্রসূতির মৃত্যুও। সন্তান প্রসব করতে গিয়ে যাঁরা মারা যাচ্ছেন, তাঁদের অন্তত ১৪ শতাংশ নাবালিকা, যা সর্বভারতীয় গড়ের (৬ শতাংশ) তুলনায় অনেকখানি বেশি। এ সব সংখ্যা এই ভয়ানক সঙ্কটের ব্যাপকতার একটা ইঙ্গিত দেয় মাত্র। মেয়েদের জীবনে তা কী বিপর্যয় বয়ে আনছে, সম্প্রতি উঠে এসেছে সংবাদে— মালদহের এক কিশোরী ষোলো বছর বয়সে প্রথম সন্তানের জন্ম দিয়েছিল, উনিশ বছর বয়সে দ্বিতীয় সন্তানের জন্ম দিতে গিয়ে মারা গিয়েছে। এ ভাবে প্রতি বছর একশোরও বেশি বাঙালি মেয়ে প্রাণ হারাচ্ছে।
নাবালিকা প্রসূতির জীবনের ঝুঁকি যে প্রাপ্তবয়স্কদের চাইতে কয়েকগুণ বেশি, তা প্রমাণিত। স্বাস্থ্যব্যবস্থার নিরিখে বিচার করলে এই মৃত্যুগুলি এক বৃহত্তর সঙ্কটের প্রতিফলন। প্রসূতি মৃত্যুর হার কমানোর জন্য হাসপাতালে প্রসবের নীতি নিয়েছিল কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার। আশাকর্মী এবং অন্য স্বাস্থ্যকর্মীদের তৎপরতায় সেই লক্ষ্যের কাছাকাছি পৌঁছনো গিয়েছে— রাজ্যে দশটি প্রসবের ন’টিই এখন হচ্ছে হাসপাতালে। অথচ, রাজ্যে প্রসূতিমৃত্যুর হার এক লক্ষ প্রসবে ১০৩, যেখানে জাতীয় হার এক লক্ষে ৯৭। প্রতিটি প্রসূতি মৃত্যুর পরেই তার কারণ নিয়ে কাটাছেঁড়া হয়। দেখা গিয়েছে, অন্তত তিনটি পর্যায়ে বিলম্ব ঘটছে— প্রসবে জটিলতা চিহ্নিত করা, প্রসূতিকে উচ্চতর হাসপাতালে যথাসময়ে রেফার করা, এবং সেখানে পৌঁছনোর পর তার চিকিৎসা। সেই সঙ্গে, অস্ত্রোপচারের দ্বারা প্রসবের আধিক্য, অস্ত্রোপচার-পরবর্তী সময়ে প্রসূতির অবস্থায় নজরদারির অভাব, হাসপাতালে সিনিয়র চিকিৎসকদের অনুপস্থিতি, এগুলিও মৃত্যুর কারণ বলে চিহ্নিত হচ্ছে।
কিন্তু প্রধান কথাটি অবশ্যই এই যে, নাবালিকাদের গর্ভবতী হওয়ার কথাই নয়। এই কিশোরীরা বেঁচে থাকত, যদি তাদের রাখা যেত স্কুলে। যদি তাদের জন্য ঘরে-বাইরে হিংসাহীন পরিবেশ নিশ্চিত করা যেত, যা তাদের উচ্চশিক্ষা, রোজগারে যুক্ত থাকতে উৎসাহিত করত। মুর্শিদাবাদ, পূর্ব মেদিনীপুর, পশ্চিম মেদিনীপুরে দশ জনে ছ’জন বালিকার বিয়ে হচ্ছে ১৮ বছরের আগে। এই বিপুল ব্যর্থতার মোকাবিলা করতে হলে রাজ্যকে কন্যাশ্রী, রূপশ্রীর মতো প্রকল্পের খামতিগুলি স্বীকার করতে হবে। বোর্ড পরীক্ষাগুলিতে প্রচুর নম্বর দেওয়ার ‘নীতি’ যে মেয়েদের স্কুলে ধরে রাখতে পারছে না তা মেনে নিয়ে স্কুলশিক্ষাকে ছাত্রীদের কাছে আকর্ষণীয়, অর্থপূর্ণ করে তুলতে হবে। সর্বোপরি, গ্রাম-মফস্সলের রাস্তা ও পরিবেশকে দুর্বৃত্ত-মুক্ত করা দরকার, যাতে হয়রানি, দুর্নামের ভয়ে দ্রুত মেয়ের বিয়ে দেওয়ার প্রবণতা কমে পরিবারে। সুস্থ রাজনীতি কেবল শাসন করে না, তা উন্নত জনজীবনের উপযুক্ত সংস্কৃতি নির্মাণ করে। মানব উন্নয়নের বিভিন্ন সূচক— মেয়েদের শিক্ষার উন্নতি, প্রসূতিমৃত্যুর হ্রাস, নারী সক্ষমতায় বৃদ্ধি— সবই ভূলুণ্ঠিত হয় নাবালিকা মায়ের মৃত্যুতে। পড়ে থাকে শুধু সুবিপুল লজ্জা।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)