পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সম্প্রতি পুকুর বুজিয়ে তৈরি বাড়ি ভেঙে দেওয়ার কথা বললেন। জলাজমি আমাদের ফুসফুসের কাজ করে— কেউ যেন তা ভরাট করতে না পারে, হুঁশিয়ারি দিলেন তিনি। প্রশ্ন হল, প্রশাসনের চোখের সামনেই যে এত দিন ধরে পুকুর চুরি চলছে, বিষয়টি কি তাঁর অজানা ছিল? তথ্য কিন্তু বলছে, তিনি আগেও জলাশয় বুজিয়ে বেআইনি নির্মাণ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন। মেয়র ফিরহাদ হাকিম একাধিক বার শাস্তির প্রসঙ্গও তুলেছেন। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রীর উদ্বেগ, পুরসভার হুঙ্কার, আদালতের নির্দেশ কোনও কিছুই বাস্তবে কাজে আসেনি, একের পর এক জলাশয়, পূর্ব কলকাতার জলাভূমির মতো রামসার তালিকাভুক্ত অঞ্চলও বেআইনি দখলদার এবং প্রোমোটার চক্রের হাতে চলে গিয়েছে। দক্ষ প্রশাসন হলে এত দিনে আইনভঙ্গকারী এবং পুরপ্রশাসনের দায়িত্বপ্রাপ্ত সকলের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হত। এই শহরে তেমন পদক্ষেপের প্রমাণ এখনও পাওয়া যায়নি। কাজেই, মুখ্যমন্ত্রীর এই হঠাৎ-আবেগকে আদৌ গুরুত্ব দেওয়ার প্রয়োজন আছে কি না, রাজ্যবাসী বিবেচনা করবেন।
কেন্দ্রীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রকের অধীন ‘দ্য ন্যাশনাল অ্যাটলাস অ্যান্ড থিম্যাটিক ম্যাপিং অর্গানাইজ়েশন’ প্রদত্ত পরিসংখ্যান অনুযায়ী, কলকাতায় পঁয়ত্রিশ-চল্লিশ বছর আগেও ন’হাজারের কাছাকাছি পুকুর ও সরোবর ছিল। তার সঙ্গে বছর চারেক আগে কলকাতা পুরসভা প্রদত্ত পুকুরের সংখ্যা মিলিয়ে দেখলে বোঝা যায়— এই সময়কালের মধ্যে পাঁচ হাজারের অধিক জলাশয়ের অস্তিত্ব কার্যত ‘নেই’ হয়ে গিয়েছে। ক্রমবর্ধমান নগর-সভ্যতা, আবাসন, শপিং মল ইত্যাদি একের পর এক জলাশয়ের মৃত্যু ঘটিয়ে নির্মিত হয়েছে। স্থানীয়রা প্রতিবাদ জানালেও নীরব থেকেছে প্রশাসন থেকে পুলিশ। সেই নীরবতা কাঞ্চনমূল্যে ক্রয় করেছে জমি-মাফিয়ারা। বাম আমলেই জলাশয়ে হাত পড়ার শুরু। বর্তমান প্রশাসনের সস্নেহ প্রশ্রয় জমি-মাফিয়াদের আরও সাহস জুগিয়েছে। বছর দুয়েক আগে মেটিয়াবুরুজের এক থানার ওসি-র বিরুদ্ধে এফআইআর-এর নির্দেশ দিয়েছিলেন মেয়র ফিরহাদ হাকিম, কর্তব্যে গাফিলতির অভিযোগে। সম্প্রতি মুখ্যমন্ত্রীও স্বীকার করেছেন, অনেক পুরসভাই পুকুর ভরাটের সঙ্গে যুক্ত। অর্থাৎ, অপরাধের পদ্ধতি চেনা, অপরাধীরাও প্রকাশ্যেই ঘোরাফেরা করেন। কিন্তু অপরাধ থামানো যায় না। চিন্তার বিষয় বইকি।
একটি পুকুর কোনও প্রয়োজনে বোজাতে গেলে সম মাপের বিকল্প একটি পুকুর খনন জরুরি। সেই নিয়ম আদৌ পালিত হয় কি? মনে রাখতে হবে, বাড়ি ভেঙে ফেললেই বুজিয়ে দেওয়া পুকুর পূর্বাবস্থায় ফিরে আসে না। কংক্রিটের চাদরে তার বাস্তুতন্ত্রের যে ক্ষতি হয়, তা অপূরণীয়। প্রশ্ন থেকে যায় অবৈধ ভাবে পুকুর বুজিয়ে নির্মাণগুলির স্থায়িত্ব নিয়েও। গত বছর গার্ডেনরিচে যে নির্মীয়মাণ পাঁচতলা বাড়িটি ভেঙে পড়ে, সেটিও এই ভাবে তৈরি। এই অঞ্চলের অধিকাংশ নির্মাণ তা-ই। পুকুর ভরাট বন্ধ করতে যাওয়ায় পুরসভার এক ইঞ্জিনিয়ারকে মারধরের অভিযোগও উঠেছিল। এমনকি এই অঞ্চলে পুকুর সমীক্ষার কাজেও বাধা এসেছিল বিস্তর। এই দীর্ঘ অনাচার চক্র শুধুমাত্র বাড়ি ভেঙে ফেললেই শেষ হবে না। প্রয়োজন একটি দল-নিরপেক্ষ পরিবেশ-সচেতন প্রশাসন। পশ্চিমবঙ্গ সেই পথ থেকে আপাতত বহু দূরে।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)