E-Paper

ঘুণ

যে কোনও ভোটের আগে-পরে হুমকি, হিংসা, রক্তারক্তি, খুন-জখমের সর্বভারতীয় মানচিত্রে যে আজ পশ্চিমবঙ্গের নাম সবার আগে ওঠে, তৃণমূল কংগ্রেস এ রাজ্যে তা নিশ্চিত করেছে।

শেষ আপডেট: ২৬ জুন ২০২৫ ০৬:৫৫

লোকসভা নির্বাচন নয়, পুরোদস্তুর বিধানসভা ভোটও না, নির্বাচনী হিংসা-অশান্তির নিরিখে কুখ্যাত পঞ্চায়েত ভোটও নয়। একটি বিধানসভা আসনের উপনির্বাচনে জয়ী হওয়ার ‘আনন্দ’-এ শাসক-আশ্রিত দুষ্কৃতীরা বিরোধী দলের সমর্থকের বাড়িতে বোমা ছুড়ছে, তাতে মারা যাচ্ছে বছর দশেকের বালিকা, এমন বীভৎস ঘটনার অকুস্থল এখন পশ্চিমবঙ্গ। যে কোনও ভোটের আগে-পরে হুমকি, হিংসা, রক্তারক্তি, খুন-জখমের সর্বভারতীয় মানচিত্রে যে আজ পশ্চিমবঙ্গের নাম সবার আগে ওঠে, তৃণমূল কংগ্রেস এ রাজ্যে তা নিশ্চিত করেছে। এক মামুলি উপনির্বাচন, অঙ্কের বিচারে ও স্থানিক জনমতের পূর্বানুমানেও যেখানে অন্তত ‘অঘটন’ ঘটার আশঙ্কা ছিল না, তাতে প্রত্যাশিত জয়লাভের পরেও যখন বিরোধীভাবাপন্ন মানুষ শুধু আক্রান্তই হন না, নিজের বাড়ির উঠোনে দাঁড়িয়ে থাকা নির্দোষ শিশুর প্রাণ পর্যন্ত চলে যায়, তখন বুঝতে হবে শাসক দলের ক্ষমতার দম্ভের বেপরোয়া উচ্চসীমার সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছে তার অধঃপতনের নিম্নগতি।

ঘটনার পরে মুখ্যমন্ত্রীর ‘দুঃখপ্রকাশ’, জড়িতদের বিরুদ্ধে দ্রুত পদক্ষেপের ‘আশ্বাস’, এমনকি রাজ্য পুলিশের হাতে কয়েকজনের গ্রেফতারিতেও আশা জাগে না, কারণ এই সবই পশ্চিমবঙ্গবাসীর আগেও দেখা। এত দিনে তাঁরা বুঝে গিয়েছেন, রাজনৈতিক বা নির্বাচনী হিংসা অথবা তার অঙ্গাঙ্গি আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির দুরবস্থা প্রসঙ্গে কথায় কথায় উত্তরপ্রদেশ বিহার বা উত্তর ভারতের উদাহরণ টানা অন্তত তৃণমূল কংগ্রেসের সাজে না। কংগ্রেস আমল ও দীর্ঘ বাম শাসনের সূত্রেও রাজ্যবাসী ভোট-হিংসার সঙ্গে যারপরনাই পরিচিত, কিন্তু ভোটের আগে-পরে লাগাতার গুন্ডামিতে, জয়োল্লাসের বীভৎস প্রাণঘাতী উন্মাদনায় রাজ্যে শাসক দল যে নজির গড়েছে তা ছাপিয়ে গিয়েছে পূর্বসূরিদেরও। তৃণমূল শাসনে ভোটের আবহে শুধু বিরোধী কর্মী বা সমর্থক নয়, নিরীহ নিরপরাধ মানুষের মৃত্যুর তথ্য-খতিয়ান দেখলেই তা স্পষ্ট হবে। শাসক দলের ছায়ায় থাকা দুষ্কৃতী বাহিনীর তৎপরতা এবং সরকারের বশংবদ পুলিশ বাহিনীর নিষ্ক্রিয়তা যে রাজ্যে ‘স্বাভাবিকতা’য় পর্যবসিত, সেখানে এক শিশুহত্যার বিচারের আশাও দুরাশা মনে হয়।

দল ও সরকার যেখানে সমার্থক, সেখানে আইনের শাসনের কথা মনে করানোর, ন্যায় ও বিচারের দাবিতে শাসকের চোখে চোখ রেখে দাঁড়ানোর কাজটি সমাজের। বিজয়ীর উল্লাসের করুণ বলি হল একটি নিষ্পাপ শিশু, শুধু এইটুকুই কি নাগরিক সমাজকে ক্ষুব্ধ, ক্রুদ্ধ করে তোলার পক্ষে যথেষ্ট নয়? সমাজমাধ্যমকে যদি সমাজমনের অংশত বহিঃপ্রকাশ বলেও ধরা যায় তা হলেও দেখা যাবে, নদিয়ার ঘটনায় নাগরিক সমাজের প্রতিক্রিয়াও রাজনৈতিক ভাবে দ্বিধাবিভক্ত: কেউ প্রাণপণ বোঝাতে চাইছেন এ একটা বিক্ষিপ্ত ঘটনা বা ক্ষতিপূরণ দিয়ে ঢাকতে চাইছেন কদর্য দুষ্কৃতি; শাসক দলের শাপান্তই কারও প্রথম ও শেষ দায়িত্ব, একটি অংশ সুযোগ বুঝে নেমে পড়েছে ধর্মীয় রাজনীতির ঘোলা জলে মাছ ধরতে। এক অমূল্য জীবনে দাঁড়ি টেনে দিল যারা, কী তাদের পরিচয়, কার অভয়হস্ত তাদের উপরে, কোন কঠোর শাস্তি তাদের হওয়া দরকার, কী ভাবে— দরকার ছিল এই দাবি তোলা: দলদাসত্ব ভুলে। সেই সমস্বরের অনুপস্থিতি বুঝিয়ে দিল, রাজনীতির পাশাপাশি এ রাজ্যের সমাজেও ঘুণ ধরেছে।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

TMC Kaliganj By Election

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy