বিপর্যয়ের সামনে দাঁড়িয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বার বার এমন সব মন্তব্য করছেন, যেগুলির মধ্যে রাজনৈতিক বা প্রশাসনিক কাণ্ডজ্ঞানের চিহ্ন খুঁজে পাওয়া ভার। উত্তরবঙ্গের ভয়াবহ বন্যার সামনে দাঁড়িয়ে কখনও তিনি ভুটানের থেকে ক্ষতিপূরণ দাবি করছেন, কখনও নদীবাঁধ ভেঙে দেওয়ার সুপারিশ করছেন। পাহাড়ের ধস নিবারণের প্রসঙ্গে ম্যানগ্রোভ, ভেটিভার ঘাস লাগাতে তিনি যে পরামর্শ দিয়েছেন, তা নিমেষের মধ্যে হাস্যকৌতুকের বিষয় হয়ে উঠেছে। স্বভাবতই বিরোধী নেতারা তাঁকে চটুল রসিকতায় বিদ্ধ করছেন। এর ফলে রাজ্যের এক গুরুতর পরিস্থিতি লঘু করে তোলা হচ্ছে। এ জন্য কেবল বিরোধীদের দুষলেই হবে না। মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্য কেন বার বার মশকরার মশলা হয়ে উঠছে, তার উত্তর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও তাঁর দলকে দিতে হবে। এক নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি এবং দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী যখন প্রশাসনিক বৈঠকে বা সাংবাদিক বৈঠকে কথা বলেন, তখন তিনি ব্যক্তি হিসেবে কথা বলেন না। তাঁর ব্যক্তিগত বিশ্বাস যা-ই হোক, জনসমক্ষে তাঁর বক্তব্যে তাঁর দলীয় অবস্থান এবং প্রশাসনিক নীতি প্রতিফলিত হবে, এটাই প্রত্যাশিত। সর্বোপরি, কোনও বড় ঘটনার অভিঘাতে যখন জনসমাজে অস্থিরতা, আশঙ্কা দেখা দেয়, তখন রাজনৈতিক নেতার সংযত, দৃঢ় ভাষণ ফের শৃঙ্খলা ও আইনের শাসনে আস্থা ফিরিয়ে আনতে পারে।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথায় সেই রাজনৈতিক প্রজ্ঞা দেখা যাচ্ছে না। তাঁর দাবি বা নির্দেশের পিছনে কী বিবেচনা কাজ করছে, তা সহসা বোঝা যায় না। সংশয় জাগে, এ সব কি সত্যিই অবিবেচক, অসতর্ক মন্তব্য, নাকি আলোচনার অভিমুখ ঘুরিয়ে দেওয়াই মুখ্যমন্ত্রীর অভিপ্রায়? দুর্গাপুরের মেডিক্যাল কলেজে ছাত্রীর গণধর্ষণের অভিযোগের পরে মমতা মেয়েদের গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কে যে কথাগুলি বললেন, তা নিয়ে ক্ষোভের বিস্ফোরণে আড়ালে চলে গেল মূল ঘটনাটি— কী করে ঘটতে পারল এমন ঘটনা? মেডিক্যাল কলেজে সুরক্ষাবিধির শিথিলতা, দুর্বৃত্তদের দাপট, আক্রান্তের পুলিশে অনাস্থা, এই প্রতিটি বিষয়ের খুঁটিয়ে তদন্তের দাবি তোলা যখন প্রয়োজন, তখন বিরোধীরা ঝুঁকলেন মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্যের অন্যায্যতা, অসারতার বিশ্লেষণে। এমন নয় যে মমতার প্রস্তাবগুলি সম্পূর্ণ অসার। বড় বাঁধ তৈরির বিরুদ্ধে যথেষ্ট যুক্তি রয়েছে, নদীর বাঁধমুক্তির জন্য নানা দেশে আন্দোলন চলছে। ডিভিসি প্রকল্পটি যে গোড়া থেকেই সমস্যাবহুল, তার প্রধান উদ্দেশ্যগুলি সাধিত হয়নি, তা নিয়েও বিতর্ক চলে না। কিন্তু ‘হয় দামোদরকে পলিমুক্ত করতে হবে না হলে বাঁধ ভেঙে দিতে হবে’— এ কি সত্যিই পশ্চিমবঙ্গ সরকারের অবস্থান? ২০২২-এ একটি প্রশ্নের উত্তরে কেন্দ্র সংসদে জানিয়ে দিয়েছিল যে, দামোদর পলিমুক্তির জন্য বরাদ্দ করছে না কেন্দ্র। তবু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ড্রেজিং না করার জন্য বারংবার দুষছেন কেন্দ্রকে। বন্যা থেকে বাঁচতে বাঁধ ভেঙে দিতে হবে, এই দাবি তুললে এ প্রশ্নও ওঠে যে, বন্যা নিয়ন্ত্রণ বা সেচের কী বিকল্প পরিকল্পনা রাজ্যের হাতে রয়েছে?
তেমনই, প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের জন্য পড়শি দেশকে দায় স্বীকার করে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে, এই দাবির পিছনে কী ধরনের বৈজ্ঞানিক বা কূটনৈতিক যুক্তি রয়েছে, তা স্পষ্ট নয়। প্রাকৃতিক উপায়ে বন্যা নিয়ন্ত্রণের পরিকল্পনা মুখ্যমন্ত্রী নিতেই পারেন। কিন্তু কী হবে তার কৌশল, সে সম্পর্কে আলোচনায় না গিয়ে মুখ্যমন্ত্রী যে মন্তব্য করলেন, তাতে মনে হতে পারে তিনি বদ্বীপ অঞ্চলের বাস্তুতন্ত্র পাহাড়ে আরোপ করার কথা বলছেন। মমতার উদ্দেশ্য সাধু হতে পারে, কিন্তু জনসমক্ষে এক নেতার কোন মন্তব্যের কী ব্যাখ্যা হতে পারে, তার ধারণাও রাজনীতিই তৈরি করে। কথা যদি ক্রমাগত তার গুরুত্ব হারিয়ে ফেলে, যা কার্যত মুখ্যমন্ত্রীর পদমর্যাদাকেই আহত করে। রাজ্যবাসীর তীব্র সঙ্কটের মুখে তাঁর মন্তব্যগুলির তরলতা, লঘুতা তাই রাজ্যের কাছে বড় মাপের দুর্ভাগ্য।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)