Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪
Women Reservation Bill

সক্ষমতার যাত্রা

যে কোনও বৈষম্যের ক্ষেত্রে আসন সংরক্ষণই নিশ্চয় সাম্যবিধানের একমাত্র পথ নহে, হয়তো শ্রেষ্ঠ পথও নহে।

শেষ আপডেট: ২৪ জুলাই ২০২১ ০৯:১৮
Share: Save:

সংসদীয় রাজনীতির মহাকাশে মহিলা বিল যেন ধূমকেতু, মাঝে মাঝে উদয় হইয়া বিতর্কের দীর্ঘ পুচ্ছ রাখিয়া প্রস্থান করে। এ বার নানা বিরোধী দলের সহিত হাত মিলাইয়া তৃণমূল সংসদের তেত্রিশ শতাংশ আসন মহিলাদের জন্য সংরক্ষণের দাবি তুলিতে চলিয়াছে। পঁচিশ বৎসর পূর্বে যে প্রশ্ন প্রথম রাখা হইয়াছিল সংসদে, বাদল অধিবেশনে সাংসদরা তাহার উত্তর খুঁজিবেন। বলা বাহুল্য, বিজেপি রাজি না হইলে প্রস্তাব ফের হিমঘরে ঢুকিবে। ২০১৪ সালে বিজেপি নির্বাচনী ইস্তাহারে লিখিয়াছিল, মহিলা বিল পাশ করিবে। অতঃপর নরেন্দ্র মোদীর শাসনকাল এবং শ্মশ্রু উভয়ই দীর্ঘ হইয়াছে, কিন্তু সংসদের দুই কক্ষে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা সত্ত্বেও এনডিএ সরকার মহিলা বিল পাশ করে নাই। বিরোধীরা মহিলা ক্ষমতায়নের প্রতি শাসক দলের দায়বদ্ধতা লইয়া প্রশ্ন তুলিয়াছেন। বিতর্ক দেখা দিয়াছে নাগরিক সমাজেও। আবার নূতন করিয়া সংরক্ষণের প্রশ্নে অনেকেই দ্বিধাগ্রস্ত, এমনকি ত্রস্ত।

যে কোনও বৈষম্যের ক্ষেত্রে আসন সংরক্ষণই নিশ্চয় সাম্যবিধানের একমাত্র পথ নহে, হয়তো শ্রেষ্ঠ পথও নহে। সমাজ নিজেই নিজেকে সংশোধন করিবে, এমনই হওয়া উচিত। কিন্তু যাহা হওয়া উচিত, আর যাহা হইয়া আসে, তাহার মধ্যে পার্থক্য এত ভয়াবহ গহ্বর তৈরি করিলে, ‘উচিত’-এর প্রতি আস্থা ন্যস্ত করিয়া বসিয়া থাকিলে ন্যায্য সমাজ গঠন করা অসম্ভব। এই দ্বন্দ্বের ভারতীয় প্রেক্ষিতটি এত দিনে পরিষ্কার। দীর্ঘ সময়ের, এমনকি শতাব্দীর, বৈষম্য সত্ত্বেও ভারতীয় বাস্তব পাল্টায় নাই। স্বাধীন দেশ এত বৎসরে সংরক্ষণের বিকল্প রাস্তা তৈরি করিতে পারে নাই। ইতিমধ্যে রাজনৈতিক দলগুলির মহিলা সমর্থকদের সক্রিয়তা এবং সাংগঠনিক ক্ষমতা প্রমাণিত, গণ-আন্দোলনে মহিলাদের অংশীদারি প্রশ্নাতীত। বিভিন্ন পেশায় ও সমাজসেবায় মেয়েরা নিজেদের উৎকর্ষের স্বাক্ষর রাখিয়াছে। তৎসত্ত্বেও গুরুত্বপূর্ণ দলীয় পদগুলি প্রায় সবই পুরুষদের কুক্ষিগত, নির্বাচনে প্রার্থীদেরও অধিকাংশই পুরুষ। একবিংশ শতাব্দীতেও রাজনৈতিক দলগুলি পুরুষতান্ত্রিকতায় অনড়। অনেক রাজ্যের বিধানসভায় মহিলার সংখ্যা কমিয়াছে। অগত্যা সংবিধান সংশোধন করিয়া সংসদের অন্তত এক তৃতীয়াংশ আসনে মহিলাদের উপস্থিতি নিশ্চিত করিবার পথটিই কেবল চোখে পড়িতেছে।

সেই পথ দীর্ঘ, কণ্টকময়। ১৯৯৬ সালে দেবগৌড়া সরকার প্রথম মহিলা বিল পেশ করিয়াছিল, কিন্তু পাশ করাইতে পারে নাই। অটলবিহারী বাজপেয়ীর সরকারও ব্যর্থ হইয়াছে। প্রথম ইউপিএ সরকারের শাসনকালে মহিলা বিল রাজ্যসভায় পাশ হইয়াছিল (২০১০), কিন্তু লোকসভায় প্রধানত মুলায়ম সিংহ যাদব ও লালুপ্রসাদ যাদবের বিরোধিতায় তাহা স্থগিত হয়। এত বৎসরেও লোকসভা সংরক্ষণের প্রস্তাবে সিলমোহর দেয় নাই। অন্য দিকে, গত পাঁচ-সাত বৎসরে শ্রমের বাজারে ভারতীয় মেয়েদের অংশগ্রহণ দ্রুত কমিয়াছে। স্বাস্থ্য, শিক্ষা, কর্মসংস্থান— যে কোনও নিরিখেই ভারতীয় মহিলারা পুরুষদের তুলনায় পশ্চাতে। দারিদ্র, অপুষ্টি, রক্তাল্পতা তাহাদের মধ্যেই বেশি। উপরন্তু মহিলাদের উপর পারিবারিক ও সামাজিক হিংসা অব্যাহত, অতিমারি তাহাকে আরও তীব্র করিয়াছে। আত্মরক্ষায় মেয়েদের অক্ষমতার অন্যতম উৎস তাহাদের রাজনৈতিক সক্ষমতার অভাব। সংরক্ষণ মেয়েদের বাস্তবিক সক্ষমতা দিতে পারিয়াছে কি না, এই বিতর্কটিও বার বার উঠে। পঞ্চায়েতে মহিলা সংরক্ষণের সাক্ষ্য কিন্তু দেখাইতেছে, দরিদ্র, প্রান্তবাসী মহিলা প্রধানরাও অর্থ বরাদ্দে নারীর প্রয়োজনকে প্রাধান্য দিয়াছেন। সংরক্ষণের ফলে নারীর প্রতি গ্রামবাসীর দৃষ্টিভঙ্গি বদলাইয়াছে। সংসদে আসন সংরক্ষণ করিলেই হয়তো সক্ষমতা আসিবে না, কিন্তু ভারতীয় নারীকে সক্ষম করিবার অন্যতম প্রাক্শর্ত হইয়া উঠিয়াছে সংরক্ষণ।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Women Reservation Bill
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE