Advertisement
E-Paper

‘দেশপ্রেমে’র ভরা মরসুমে যেন দেশ কম, দ্বেষই বেশি

কেউ কেউ ‘বদলা’র বিরুদ্ধে কথা বলছেন। যুদ্ধ নয়, কথার মাধ্যমে কাশ্মীর সমস্যার সমাধান চাইছেন। এটাই তাঁদের ‘অপরাধ’। লিখছেন মোহিত রণদীপকেউ কেউ ‘বদলা’র বিরুদ্ধে কথা বলছেন। যুদ্ধ নয়, কথার মাধ্যমে কাশ্মীর সমস্যার সমাধান চাইছেন। এটাই তাঁদের ‘অপরাধ’। লিখছেন মোহিত রণদীপ

শেষ আপডেট: ২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ০২:৩৪
—ফাইল চিত্র।

—ফাইল চিত্র।

গত চোদ্দোই ফেব্রুয়ারি কাশ্মীরের পুলওয়ামায় সেনা-কনভয়ে ঘটে যাওয়া হামলার পর সারা দেশের মানুষ স্তব্ধ হয়ে যান। দেশজুড়ে নেমে আসে শোকের ছায়া। ক্ষোভে ফেটে পড়ে মানুষ। এ সবই সঙ্গত। এমনই তো হওয়ার কথা। এত জন জওয়ান যখন এই জঙ্গি হামলার শিকার হন, নিহত হন... তখন এই শোক, এই ক্ষোভ সঙ্গত।

কিন্তু কাদের বিরুদ্ধে এই ক্ষোভ? কাদের উপর শোধ তুলতে চাইছি আমরা? কারা সত্যিকারের অপরাধী?

এখনও পর্যন্ত যাঁরা এই ক্ষোভের শিকার হয়েছেন, তাঁরা কেউ পাকিস্তান থেকে আসা জঙ্গি নন, জঙ্গিবাদের সমর্থকও নন। এঁরা প্রত্যেকেই এই দেশের নাগরিক, এই মাটিতেই বড় হয়ে উঠেছেন। এঁদের মধ্যে কেউ হয়তো কাশ্মীরের মানুষ— তাঁদের কেউ পেশায় চিকিৎসক, কেউ শাল বিক্রেতা, কেউ হয়তো ধর্মীয় পরিচয়ে মুসলিম, কেউ হয়তো যুদ্ধ বিরোধী, শান্তিকামী ভিন্ন মতের মানুষ।

জম্মুতে সংখ্যালঘুদের ঘরবাড়ি পুড়েছে। দেহরাদুনে কাশ্মীরের কলেজ ছাত্রীদের হস্টেল ঘেরাও করে তাণ্ডব চলেছে। এ রাজ্যেও তার ছোঁয়া লেগেছে। ‘দেশপ্রেমিকদের’ হাতে একের পর এক আক্রান্ত হয়েছেন অনেকেই। আক্রান্তদের মধ্যে রয়েছেন সতেরো বছরের কিশোর, কলেজ পেরনো যুবক, কলেজ ছাত্রী, স্কুল শিক্ষক, রয়েছেন বৃদ্ধ মানুষও। চারদিকে ‘বদলা’র হুঙ্কারের মাঝে যুদ্ধের বিরুদ্ধে কথা বলার অপরাধে জঙ্গিহামলায় নিহত সৈনিক বাবলু সাঁতরার স্ত্রীর চরিত্র নিয়ে সংশয় প্রকাশ করা হয়েছে। ‘দেশাত্মবোধ’ প্রবল ভাবে জেগে ওঠা এই মানুষদের একটা বড় অংশ সোশ্যাল নেটওয়ার্কের মাধ্যমে সংখ্যালঘু এবং ভিন্ন মতের মানুষদের উদ্দেশ্যে অশ্লীল গালির বন্যা বইয়ে দিচ্ছেন।

ভিন্ন মত ব্যক্ত করার অপরাধে ডানলপের কাছে একটি বেসরকারি স্কুলের শিক্ষক চিত্রদীপ সোমের বাড়িতে হামলা হয়েছে। বাড়ি-ছাড়া হতে হয়েছে সস্ত্রীক। স্কুল কর্তৃপক্ষ চাকরি ছাড়তে বাধ্য করেছেন। হাবড়াতে কিশোর অর্পণ রক্ষিত ফেসবুকে ভিন্ন মত প্রকাশের অপরাধে আক্রান্ত হয়। পুলিশ এ ক্ষেত্রে প্রথমে সেই কিশোরের নিরাপত্তার দায় ঝেড়ে ফেলে থানার বাইরে ফয়সালা করে নিতে বলে। পরে হামলাকারীদের চাপে অর্পণকেই গ্রেফতার করে লকআপে চালান করে। কোচবিহারেও আক্রান্ত হয়েছে এক কিশোর। রানাঘাটে এক কাশ্মীরের বাসিন্দা শাল বিক্রেতাকে ঘরের মধ্যে ডেকে এনে ‘জয় হিন্দ’ বলতে চাপ দেওয়া হয়। পরীক্ষা নেওয়া হয় তাঁর দেশপ্রেমের। দক্ষিণ কলকাতায় এক কাশ্মীরের চিকিৎসকের বাড়িতে হামলা হয়।

একের পর এক এক হামলা শুরু হয়েছে বিভিন্ন প্রান্তে। একটা আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি করা হচ্ছে। সংখ্যালঘু মানুষের প্রতি ছুঁড়ে দেওয়া হচ্ছে বিদ্বেষের বাণ। সব সংখ্যালঘু মানুষকেই চিহ্নিত করা হচ্ছে ‘দেশদ্রোহী’ হিসাবে। বাড়িতে গিয়ে হামলা হচ্ছে, বাধ্য করা হচ্ছে ক্ষমা চাইতে।

মানবাধিকার কর্মী, শান্তি আন্দোলনের কর্মী, শাসকদলের বিরুদ্ধে প্রশ্ন তুলতে সাহসী তরুণ তরুণী, ছাত্র আন্দোলনের কর্মীরাও ‘শত্রু-তালিকায়’! তাঁদের অপরাধ, তাঁরা ‘বদলা’র বিরুদ্ধে কথা বলছেন, যুদ্ধ-জিগিরের বিরুদ্ধে সোচ্চার হচ্ছেন, কথার মাধ্যমে কাশ্মীর-সমস্যার সমাধান চাইছেন, ঘরের ছেলেমেয়েদের মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়ার বিরুদ্ধে সওয়াল করছেন।

এই সব মানুষকে চিহ্নিত করে তাদের নানা ভাবে শাসানো চলছে, হেনস্থা করা চলছে। এঁদের মধ্যে কেউ কেউ আতঙ্কের শিকার আজ। পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেসের শিকার কত জন হলেন, তা অদূর ভবিষ্যতেই হয়তো জানা যাবে। ভিন্ন ধর্ম, ভিন্ন মতের কারণে সহনাগরিকের উপর এই হামলা, এই সন্ত্রাসের সঙ্গে দেশপ্রেমের সম্পর্ক কোথায়?

এই সব ‘দেশপ্রেমিক’ লক্ষাধিক কৃষক যখন না খেতে পেয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নেন তখন চুপ থাকেন। পাকিস্তানের মদতপুষ্ট এই জঙ্গি হামলা সম্পর্কে আগাম খবর থাকা সত্ত্বেও সেনা কনভয়ের নিরাপত্তা ব্যবস্থা এতখানি ঢিলে ঢালা কেন থাকে, কার স্বার্থে থাকে? কোন অজ্ঞাত কারণে আকাশপথের যাত্রা বন্ধ করে দিয়ে বিপদসঙ্কুল দীর্ঘ সড়কপথে সেনাবাহিনীকে পাঠানো হয়? এই সব প্রশ্নের উত্তরে চুপ থাকেন, এড়িয়ে যান।

কখনও এই সব ‘দেশপ্রেমিক’ নেতাদের বাড়ির ছেলেমেয়েদের কাউকে তো দেখি না সেনাবাহিনীতে যেতে? গরিব কৃষক-শ্রমিক-মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলেমেয়েরাই যুদ্ধে যায়।

প্রতিটি যুদ্ধে সর্বনাশের মুখোমুখি মুখোমুখি তো এঁদেরই হতে হয়। আর নেতাদের নাম জড়ায় অস্ত্র-যুদ্ধবিমান কেনাবেচার নানা কেলেঙ্কারিতে, এমনকি, মৃত সৈনিকের কফিন নিয়েও আর্থিক কেলেঙ্কারি হয়। কার্গিল যুদ্ধের পর এই অভিযোগ উঠেছিল, পদত্যাগ করতে হয়েছিল তৎকালীন প্রতিরক্ষা মন্ত্রীকে। ফায়দা সেই সব নেতানেত্রীর হয়, ফায়দা হয় যুদ্ধ-জিগির তোলা মানুষদের।

উল্টে এই হামলায় নিহত বাবলু সাঁতরার স্ত্রী যখন যুদ্ধের বিরুদ্ধে কথা বলেন তখন তাঁর চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়! কেন কাশ্মীর সমস্যাকে বছরের পর বছর টিকিয়ে রাখা হয়, কেন প্রতিটি ভোটের আগে শাসকদের যুদ্ধের রব তুলতে হয়, এটা ভেবে দেখা দরকার। আর যাঁদের প্রবল দেশপ্রেম, তাঁরা নিজেরা বরং সেনাবাহিনীতে নাম লেখান, বাড়ির ছেলেমেয়েদের পাঠান সেনাবাহিনীতে। দেশপ্রেমের প্র্যাকটিক্যাল পরীক্ষা দেওয়ার এমন সুযোগ হাতছাড়া করবেন না।

সুস্থ বোধবুদ্ধি সম্পন্ন কোনও মানুষ হিংসা কিংবা যুদ্ধ চায় না। এই উথলে ওঠা ‘দেশাত্মবোধের’ পিছনে আসল কারণ গত পাঁচ বছরে শাসক দলের সার্বিক ব্যর্থতা। সমস্ত ক্ষেত্রে ব্যর্থ এই দল এখন পরিকল্পিত ভাবে এই হুজুগ তুলছে। ভিন্ন মতের নাগরিকদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে হামলা করছে। কার্গিল যুদ্ধে নিহত সেই সৈনিকের কন্যা, পুলওয়ামায় নিহত বাবলু সাঁতরার স্ত্রীর কাছে তাঁদের নিকট জনের প্রাণের মূল্য অনেকখানি, দেশের জন্য তাঁদের প্রাণ দিতে হয়। তাই তাঁরা যুদ্ধের বিরুদ্ধে সরব হন।

পেশাগত ক্ষেত্রে এক জন কাউন্সেলর হিসাবে অভিজ্ঞতা হয়েছে, কাশ্মীরের পাক সীমান্তে সীমান্তরক্ষীর মুখোমুখি হওয়ার। যুদ্ধকে কতটা ঘৃণা করেন তিনি, তা দেখেছিলাম সে দিন। বলেছিলেন, ‘‘ও পারেও সীমান্তে যে আমাদের দিকে রাইফেল তাক করে দাঁড়িয়ে তার সঙ্গে তো আমার ব্যক্তিগত কোনও শত্রুতা নেই। ওরও নেই। তবু আমাদের দু’জনকেই মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয়!’’

ঘটনা এই যে, আমাদের এই হামলাবাজ দেশপ্রেমিকদের কাছে ‘দেশপ্রেম’ মানে মুসলিম বিরোধিতা। পুলওয়ামাতে সেনা কনভয়ে এই হামলায় যাঁরা নিহত তাঁদের মধ্যে ছিলেন এক জন কাশ্মীরের মুসলিম সেনাও। সেনাবাহিনীতে মুসলিম জওয়ানের সংখ্যা নেহাত কম নয়। কাশ্মীরের মানুষ মানেই তিনি অপরাধী নন— কবে বুঝবে এই হুজুগে দেশপ্রেম? যেখানে প্রেমের আড়ালে শুধুই হিংসা আর প্রতিশোধের বিষ জমছে।

এই ‘দেশপ্রেমিকেরা’ বাড়ির পাশের সহ-নাগরিকের ওপর হামলা করে বীরত্ব ফলান। তাঁদেরকে ভয় দেখিয়ে মানবিকতার খুন করেন প্রেমের নামে।

আসলে, এই সব হিংসা-প্রেমী, যুদ্ধ-প্রিয়, হুজুগে ‘দেশপ্রেমে’ দেশ একেবারেই নেই। আছে শুধুই দ্বেষ।

মনোবিদ (মতামত নিজস্ব)

Pulwama Pulwama Terror Attack Pulwama Attack
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy