Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
Rabindranath Tagore

জনস্বাস্থ্য কর্মী রবীন্দ্রনাথ

তিনি বুঝেছিলেন, মহামারি-পীড়িত গ্রামকে বাঁচাতে শুধু সরকারি ব্যবস্থাপনায় কাজ হবে না।

জ্যোতিপ্রসাদ রায়
শেষ আপডেট: ০৮ অগস্ট ২০২০ ০০:০১
Share: Save:

কলেরা, গুটিবসন্ত, প্লেগ, যক্ষ্মা, ম্যালেরিয়ার মুখোমুখি হওয়া রবীন্দ্রনাথ ইতিহাস ও অভিজ্ঞতার সূত্রে জেনেছিলেন, অদৃশ্য ঘাতক জীবাণু কী ভাবে দাঁত বসায় সুস্থ সমাজ ও সংস্কৃতির গতিশীল বুনিয়াদে। তাঁর মারি-অভিজ্ঞতার প্রতিক্রিয়া দু’রকম। সংক্রামক ব্যাধিতে বিপর্যস্ত সমাজ-সংস্কৃতির রূপকে সৃষ্টিতে গেঁথে রাখা, আর গণপরিসরে নিজেই জনস্বাস্থ্য কর্মী হয়ে ওঠা। ‘গোরা’ উপন্যাসে কলেরায় স্বামী-সন্তানহারা হরিমোহিনীর বিলাপে দৈব-বিশ্বাসী বাঙালি সমাজমানসের আত্মনিয়ন্ত্রণহীন কপাল-চাপড়ানো রূপ তিনি এঁকেছেন নিরাসক্ত দৃষ্টিতে। বঙ্গদেশে ১৮৯৮-১৯০৮ পর্যন্ত প্লেগ রুখতে সরকারি উদ্যোগ থাকলেও কেউ চট করে চিকিৎসালয়মুখী হত না। আতঙ্কিত মানুষ দেখেছিল, প্লেগ রোগী সরকারি চিকিৎসালয়ে যায় কিন্তু ‘জ্যান্ত’ বাড়ি ফেরে না। সরকারি চিকিৎসার প্রতি জনমনে ছিল ভয়, বিদেশি স্বাস্থ্য প্রশাসনের প্রতি অনাস্থা। তাই ‘চতুরঙ্গ’ উপন্যাসে প্লেগ থেকে বাঁচতে জগমোহন চাঁদা তুলে স্বদেশি হাসপাতাল খোলে। আবার ‘দিদি’ গল্পে ওলাউঠা থেকে মুক্তি পেতে গ্রামীণ ‘নেটিভ’ ডাক্তারের চেয়ে শহুরে অ্যালোপ্যাথি চিকিৎসকে আস্থা রাখে গ্রাম্য বধূ শশিকলা। ‘দুর্বুদ্ধি’ গল্পে ডাক্তার ওষুধ ছাড়াও বিশ্বাস করে কর্মফলে। মহামারি-প্রেক্ষিতে জনমানসের ব্যবহারিক ও মনস্তাত্ত্বিক গতি-প্রকৃতিকে সাহিত্যে ধরেছেন রবীন্দ্রনাথ। সে প্রসঙ্গগুলি সাহিত্যের নান্দনিক মাত্রা পুষ্ট করেছে, তারও বেশি তুলে ধরেছে জনস্বাস্থ্য সম্পর্কে প্রচলিত ধ্যানধারণা বিশ্বাস ও সংস্কার-আশ্রিত জীবনযাত্রার স্বরাঘাত।

চিঠিপত্রে, প্রবন্ধে (‘ম্যালেরিয়া’, ‘সমবায়ে ম্যালেরিয়া নিবারণ’, ‘দেশের কাজ’ ইত্যাদি) ও কবিতাতেও (‘পুরাতন ভৃত্য’, ‘অভিসার’, ‘নৈবেদ্য’-এর ৯২-সংখ্যক কবিতা) মহামারি নিছক প্রসঙ্গ নয়। রবীন্দ্রনাথ দেখালেন, গুটিবসন্ত, কলেরা, ম্যালেরিয়া ইত্যাদি জীবাণুবাহিত রোগ কোনও স্থানিক বিষয় নয় (বৃন্দাবনে গিয়ে বসন্তে আক্রান্ত হয় মনিব ও ভৃত্য), আবার নির্দিষ্ট কালের খড়ি টেনে মড়কের জন্মদিন চিহ্নিত করাও বাতুলতা। মহামারির আতঙ্কে কোণঠাসা জনগণকে সারকথা বোঝাতে রবীন্দ্রনাথ ফিরে যান বৌদ্ধ যুগে। সে কালেও সংক্রমণ থেকে রক্ষা পায়নি সমাজ, গুটিবসন্তে আক্রান্ত হয়েছেন নটী বাসবদত্তা। ছোঁয়াচে রোগাক্রান্ত মানুষকে কোনও কালে সমাজ কোল দেয় না, নিজেকে বাঁচাতে ঘরে-বাইরে তৈরি করে স্পৃশ্য-অস্পৃশ্যের দেওয়াল।

তিনি বুঝেছিলেন, মহামারি-পীড়িত গ্রামকে বাঁচাতে শুধু সরকারি ব্যবস্থাপনায় কাজ হবে না। ১৯২১-এ শান্তিনিকেতনের কাছে ম্যালেরিয়াগ্রস্ত জনপদে পথে নামলেন, ধারাবাহিক প্রচেষ্টার জোরে নেতিয়ে পড়া গাঁ-গঞ্জের মনে গেঁথে দিলেন সাহস ও বিশ্বাস। ওষুধ, চিকিৎসা সরঞ্জাম, দেশি-বিদেশি ডাক্তার-স্বাস্থ্যকর্মী নিয়ে পল্লিতে পল্লিতে খোলা হল সেবাকেন্দ্র। ম্যালেরিয়া-আক্রান্ত গ্রামকে সুস্থ করতে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গী হলেন দক্ষ জীবাণু বিশেষজ্ঞ, দ্য সেন্ট্রাল কো-অপারেটিভ অ্যান্টি-ম্যালেরিয়া সোসাইটি’-র সেক্রেটারি গোপালচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, আমেরিকার রকফেলার ফাউন্ডেশনের ভারতীয় পূর্বাঞ্চলীয় পরিদর্শক ডাক্তার জে এফ কেন্ড্রিকও।

নির্বাচিত যুবকদের প্রশিক্ষণ দিয়ে স্বাস্থ্যকর্মী তৈরি করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। আজকের করোনা-যুদ্ধে পাড়ায়-পাড়ায় সক্রিয় আশা কর্মীরা রবীন্দ্রভাবনারই মূর্ত রূপ যেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, বাইরে থেকে মানুষের প্রতিদিনের প্রয়োজন মেটানো যায় না, বরং নিজের সমস্যাকে চিনতে পারার চেতনা তাদের মধ্যে জাগিয়ে তুললে সংক্রমণ সম্পর্কে অ-শিক্ষিত, দৈব-বিশ্বাসী গ্রামগুলি স্বনির্ভর হবে। গ্রামীণ জনপদে এই গণচেতনার জাগরণ ও বিস্তারে সফল হয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ, ‘...তার একটা প্রমাণ আছে আমাদের প্রতিবেশী গ্রামগুলিতে সম্মিলিত আত্মপ্রচেষ্টায় আরোগ্য-বিধানের প্রতিষ্ঠা’য় (‘ম্যালেরিয়া’ প্রবন্ধ)। শান্তিনিকেতনে এসে তাঁর কাজ দেখে মুগ্ধ হন বিশ্ব-ম্যালেরিয়া নিবারণে সক্রিয় মার্কিন ডাক্তার জে এফ কেন্ড্রিক, সংক্রামক রোগ প্রতিরোধে পরে তাঁর কাছে ‘মডেল’ হয়ে উঠেছিল রবীন্দ্রনাথের ভাবনা। প্রত্যন্ত গ্রামীণ স্তরে বেসরকারি উদ্যোগে মহামারি প্রতিরোধে রবীন্দ্রনাথ স্বাস্থ্য সচেতনতার ওপর জোর দিয়েছিলেন, সক্রিয় ছিলেন বিশেষজ্ঞ স্বাস্থ্যকর্মী সংগ্রহেও। শান্তিনিকেতনের চার পাশে ম্যালেরিয়া প্রতিরোধে কাজ করেছিলেন লেনার্ড এলমহার্স্ট, ডাক্তার হ্যারি টিম্বার্স প্রমুখ। নিজেদের শ্রম ও অর্থ বটেই, বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকেও অর্থ সংগ্রহ করে রবীন্দ্রনাথের হাতে তুলে দিয়েছিলেন তাঁরা।

জনস্বাস্থ্য কর্মী রবীন্দ্রনাথও তাই স্মরণীয়। স্থানীয় ভিত্তিতে এলাকা জীবাণুমুক্তকরণ, স্বাস্থ্যবিধির প্রচার ও বাস্তবায়নে নজরদারি, সংক্রমিত রোগী ও তার পরিবারকে সাহায্য, বিশেষজ্ঞ ডাক্তার ও স্বাস্থ্যকর্মীর সঙ্গে পূর্ণ সহযোগিতার পথটি তিনি দেখিয়েছেন। সেই পথেই তো ‘‘যে মন্ত্রে দেহের রোগ দূর হবে সে মন্ত্রে মনের যে দীনতা পরনির্ভরতা তাও দূর হবে।’’

বাংলা বিভাগ, কোচবিহার পঞ্চানন বর্মা ইউনিভার্সিটি

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Rabindranath Tagore Health Worker
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE