পশ্চিমবঙ্গের অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র গত ২৭ সেপ্টেম্বর কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলিকে চতুর্দশ অর্থ কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী সাংবিধানিক ভাবে প্রাপ্য রাজ্য সরকারের করের ভাগ পাওয়ার বিলম্বজনিত কারণের জন্য একটি প্রতিবাদপত্র লিখেছেন। তিনি ওই চিঠিতে লিখেছেন, ‘কেন্দ্রীয় করের ভাগ পাওয়াটা রাজ্যের সাংবিধানিক অধিকার, কেন্দ্র ইচ্ছেমত সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। এমন একতরফা সিদ্ধান্ত কাঠামোর কেন্দ্র রাজ্য সম্পর্কের ধারণার পরিপন্থী’। (আনন্দবাজার পত্রিকা, ২-১০) ভারতীয় সংবিধানের প্রতি আস্থা ও বিশ্বাস রয়েছে এমন যে কোনও মানুষই অমিত মিত্রের এই পত্রের সঙ্গে সহমত পোষণ করবেন।
ভারতীয় সংবিধানের ২৮০নং ধারা অনুযায়ী কেন্দ্রীয় সরকার প্রতি ৫ বছর অন্তর অন্তর একটি করে অর্থ কমিশন গঠন করতে বাধ্য। এই অর্থ কমিশনের দায়িত্ব কেন্দ্র ও রাজ্যগুলির মধ্যে আদায়িকৃত করের ভাগের অংশ ঘোষণা করা ও কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষ থেকে তা কার্যকর করা। ৭৩ ও ৭৪তম সংবিধান সংশোধনের পর সংবিধানের ২৮০নং ধারার দুটি সংশোধনী যুক্ত করা হয়। ‘বি বি’ এবং ‘সি’। তাতে বলা হয় শুধু কেন্দ্র-রাজ্যের মধ্যে রাজস্বের ভাগ নয়, কেন্দ্রীয় অর্থ কমিশনের দায়িত্ব পঞ্চায়েত ও পুরসভাগুলির নিজস্ব আর্থিক অবস্থার উন্নতি ঘটাতেও সুপারিশ করা।
একই ভাবে ৭৩ ও ৭৪তম সংবিধান সংশোধনের পর সংবিধানে ২৪৩-এর বি এবং ২৪৩ কিউ ধারা অনুযায়ী পঞ্চায়েত ও পুরসভা দুটি ব্যবস্থাকেই স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা বা সাংবিধানিক সংস্থা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। সংবিধানের ২৪৩ আই ধারা অনুযায়ী প্রতি ৫ বছর পর পর রাজ্য অর্থ কমিশন গঠন করতে বাধ্য রাজ্য সরকারগুলি। রাজ্য অর্থ কমিশন সুপারিশ করে থাকে রাজ্য এবং পঞ্চায়েত ও পুরসভাগুলির মধ্যে রাজ্য সরকারের রাজস্বের অংশের ভাগাভাগির।
কেন্দ্রীয় অর্থ কমিশনের সুপারিশের পর যেমন কেন্দ্রীয় সরকার সেই সুপারিশের ভিত্তিতে ব্যবস্থা গ্রহণের সিদ্ধান্ত বা অ্যাকশন টেকেন রিপোর্ট প্রস্তুত করে, তেমনি রাজ্য সরকারগুলিকেও তা করতে হয়। কেন্দ্র-রাজ্যের মধ্যে রাজস্ব বা করের ভাগাভাগির অংশ যেমন কেন্দ্রীয় সরকার অর্থ কমিশনের সুপারিশ মতো ঘোষণা করে থাকে, তেমনি রাজ্যগুলির প্রাপ্য অর্থের অংশও কেন্দ্র ঘোষণা করে। একই ভাবে রাজ্য অর্থ কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী রাজ্য সরকারগুলিকেও এই সুপারিশের ভিত্তিতে ব্যবস্থা গ্রহণ বা অ্যাকশন টেকেন রিপোর্ট প্রস্তুত করতে হয়। রাজ্য সরকার, রাজ্য অর্থ কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী রাজ্যের কোন পঞ্চায়েত বা পুরসভা রাজস্বের কত অংশ পাওয়ার অধিকারী, তাও ঘোষণা করে থাকে।
পশ্চিমবঙ্গে ২০০৬ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি ভারতীয় সংবিধানের ২৪৩ আই (৪) এবং ২৪৩ ওয়াই (২) ধারা অনুসারে তৃতীয় রাজ্য অর্থ কমিশন গঠিত হয়েছিল। ২০০৮ সালের ৩১ অক্টোবর তৃতীয় রাজ্য অর্থ কমিশনের সুপারিশ গ্রহণ করে অ্যাকশন টেকেন রিপোর্টও প্রস্তুত করা হয়েছিল। ২০১৩ সালে এর মেয়াদও শেষ হয়ে যায়। ইতিমধ্যে রাজ্যে নতুন সরকার দায়িত্বভার গ্রহণের পর অভিরূপ সরকারের নেতৃত্বে চতুর্থ অর্থ কমিশন গঠিত হয় এবং রাজ্য সরকারের কাছে তাদের সুপারিশও জমা দেয়। কিন্তু আজও তা কার্যকর হয়নি।
রাজ্যের অর্থমন্ত্রী অত্যন্ত ঠিক ভাবেই কেন্দ্রের কাছে রাজ্যের সাংবিধানিক পাওনার প্রশ্ন তুলেছেন। কিন্তু তিনি এক বার কী খবর নিয়ে দেখেছেন, পশ্চিমবঙ্গের সমস্ত পঞ্চায়েত ও পুরসভাগুলি ঠিক সময়ে ও ঠিক ভাবে চতুর্দশ অর্থ কমিশন বা তৃতীয় রাজ্য অর্থ কমিশনের সুপারিশকৃত আর্থিক অনুদান পেয়ে থাকে কি না? শিলিগুড়ির মতো পুরসভা বিগত ৩টি আর্থিক বছরে রাজ্য অর্থ কমিশনের অর্থ পেয়েছে খুবই অনিয়মিত ভাবে। অন্তত দুটি কিস্তির অর্থ শিলিগুড়িকে আজও দেওয়া হয়নি।
মাননীয় রাজ্য অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র যেমন বলেছেন কেন্দ্রীয় করের ভাগ পাওয়াটা রাজ্যের সাংবিধানিক অধিকার, তেমনি রাজ্য সরকারের কাছ থেকে পঞ্চায়েত ও পুরসভার ভাগ পাওয়াটাও তাদের ক্ষেত্রে সাংবিধানিক অধিকার। একই ভাবে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে কোনও একটি পুরসভাকে অন্তর্ভুক্তির দাবিও সাংবিধানিক। কেন্দ্রীয় সরকারের উদ্যোগে এবং রাজ্য সরকারের সহযোগিতায়, পুরসভাগুলির মাধ্যমে কার্যকর করতে গত কয়েক বছর ধরে বিভিন্ন নামে চালু রয়েছে অনেকগুলি উন্নয়ন প্রকল্প। সংবিধান ও আইন অনুযায়ী কেন্দ্রীয় বা রাজ্য সরকারের বিভিন্ন প্রকল্প বা অর্থ কমিশনের আর্থিক অনুদান ভিত্তিক কর্মসূচিগুলিতে যে কোনও পুরসভার সহযোগিতা পাওয়া বা অন্তর্ভুক্ত হওয়ার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক ভাবে পছন্দ অপছন্দের সুযোগ নেই। অর্থ কমিশনের ক্ষেত্রে জনসংখ্যা ও এলাকা ব্যতীত অন্য কোনও শর্ত নেই। অথচ পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান রাজ্য সরকার রাজনৈতিক অবস্থানকেই রাজ্য সরকারের কাছ থেকে প্রাপ্য আর্থিক সহযোগিতা বা অনুদান পাওয়ার ক্ষেত্রে বড় শর্ত হিসেবে গ্রহণ করার নীতি নিয়েছে।
রাজ্যের রাজস্ব বা কেন্দ্রীয় অর্থ কমিশনের ভাগ বা কোনও প্রকল্পের সুযোগ পাওয়াও যে কোনও পুরসভার পক্ষে সাংবিধানিক অধিকার। এ সব ক্ষেত্রে রাজ্য সরকার যথেচ্ছ সিদ্ধান্ত নিতে পারে না।
শিলিগুড়ি পুরসভার মেয়র
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy