Advertisement
১৮ এপ্রিল ২০২৪

অনেক স্বার্থেই ঘা পড়ছে

শিক্ষায় স্বাধিকারের দাবিতে যে কলরোল, তাকে স্বীকৃতি দিতে গেলে আগে সামাজিক প্রেক্ষাপটটিকে স্বীকার করা প্রয়োজন। পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে এই প্রেক্ষাপটের কথা এ লেখার প্রথম পর্বে (‘শিক্ষার প্রসার...’, ৩১-৭) বলা হয়েছে।

রণবীর সমাদ্দার
শেষ আপডেট: ০১ অগস্ট ২০১৮ ০০:০০
Share: Save:

শিক্ষায় স্বাধিকারের দাবিতে যে কলরোল, তাকে স্বীকৃতি দিতে গেলে আগে সামাজিক প্রেক্ষাপটটিকে স্বীকার করা প্রয়োজন। পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে এই প্রেক্ষাপটের কথা এ লেখার প্রথম পর্বে (‘শিক্ষার প্রসার...’, ৩১-৭) বলা হয়েছে। একটা মৌলিক প্রশ্ন পরিষ্কার করে বলা দরকার। শিক্ষায় স্বাধিকারের ভূমিকা আছে, কিন্তু সেই স্বাধিকার কি শুধু স্বল্পসংখ্যক উচ্চশিক্ষিতদের জন্য, কিছু প্রতিষ্ঠানের জন্য? তার কোনও সর্বাঙ্গীণ রূপ থাকবে না? শত শত কলেজ এবং নানা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বাধিকারের কী হবে? তার সর্বাঙ্গীণ কাঠামোর আইনগত চরিত্র কী থাকবে? এ সব যাঁরা শিক্ষাঙ্গনে জড়িত, তাঁদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে স্থির হতে পারে। উচ্চশিক্ষা কাউন্সিল আছে, যারা এই আলোচনার উদ্যোগ করতে পারে।

এটা হতে পারে না যে স্বাধিকার শুধু বিত্তশালী এবং খ্যাতনামা প্রতিষ্ঠানের জন্য এবং বাকিদের ভার সরকারের। সমাজে আমরা দেখছি, বিত্তশালীরা সর্বত্র সরকারের থেকে মুক্তি চান। স্বাধিকারের ভিত্তিতে বাসস্থান, ক্লাব, শিল্পব্যবসায়ের স্ব-অধিকৃত শিক্ষাব্যবস্থা— কোনও কিছুতেই সরকারের প্রয়োজন নেই। শুধু দরকার মতো টাকা যেন রাষ্ট্র জুগিয়ে যায়। সরকার খ্যাতনামাদের ইচ্ছামতো যেন চলে। নব্য উদারনীতিবাদের যুগে শিক্ষাব্যবস্থার এই দ্বিমুখী চরিত্র নজরে পড়ার মতো। এক দিকে সাধারণ মানুষের শিক্ষাঙ্গনে হানা, অন্য দিকে যাঁরা শিক্ষিত তাঁদের অনন্ত প্রয়াস নিজেদের দুর্গ সামলানোর। খ্যাতি, মান, স্বীকৃতি— এ সবই সেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নামক দুর্গের বিভিন্ন স্তম্ভ। ফলে সাধারণ পরীক্ষা, সাধারণ আচরণ ব্যবস্থা, সাধারণ প্রবেশিকা বিধি গৌণ হয়ে যাবে। প্রধান হবে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব স্থিরীকৃত আচরণবিধি। এই সমস্যার সমাধান আলাপ-আলোচনার মধ্য দিয়ে হতে পারে। একতরফা বলে দেওয়া যায় না যে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের স্বাধিকার পবিত্রতম অধিকার।

আমি জানি শ্রেণিস্বার্থের কথা তুলে আবার তিরস্কৃত হওয়ার ঝুঁকি নিচ্ছি। তিন চার বছর আগে শিক্ষা ক্ষেত্রে নয়া উদার-নীতিবাদের ইঙ্গিত দেওয়ায় কলকাতায় এক বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ের দেশেবিদেশে কর্মরত অধ্যাপক অধ্যাপিকারা আমায় তুলোধোনা করেছিলেন। বলেছিলেন আমি ‘বিপ্লবী প্রাচীনপন্থী’। এ ক্ষেত্রেও শ্রেণিস্বার্থের কথা তোলায় একই তিরস্কারের সম্ভাবনা থেকে যাবে।

শিক্ষা প্রসারের ফলে শিক্ষা ক্ষেত্রে সংঘাতের একটা দিকের কথা বলে এই লেখার শেষ। বছরখানেক আগের খবরের কাগজের কথা স্মরণ করুন। কাগজের প্রথম পাতা খুললে মনে হত সিন্ডিকেট ত্রাসে পশ্চিমবঙ্গ স্তব্ধ। এখন মনে হয় কলেজ ভর্তি মানেই লাখ লাখ টাকা, দাদা এবং পার্টিবাজদের আয়। এর মধ্যে কিছু সত্যি আছে। সরকারি উদ্যোগে যেখানেই সম্পদ সৃষ্টি হবে, এই অর্থনৈতিক অবস্থায় তার কিছু ভাগ মধ্যস্বত্বভোগীরা নিতে উদ্যত হবে। ক্ষুদ্র জীবিকা এবং স্বনির্ভর উদ্যোগের ওপর কোনও মতে ভরসা করে চলা মানুষদের একাংশ এই মধ্যস্বত্বভোগীদের সংখ্যা বাড়াবে। সরকার একটা দূর পর্যন্ত একে দৃঢ় হাতে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে। শক্ত, সংগঠিত পরিবর্তনকারী দল প্রশাসনে থাকলে এই নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করতে পারবে। অগ্রণী ভূমিকা নিতে পারবেন যেখানে কলেজ রয়েছে সেই সব পাড়ার রাজনৈতিক এবং সামাজিক কর্মীরা। কিন্তু শুধু জনপ্রিয়তাবাদী প্রশাসন একে পুরোদস্তুর সামলাতে পারবে বলে মনে হয় না। শিক্ষায় যে বিপুল বৃদ্ধি, তার একাংশ যে খাজনাসুলভ আয়ে পরিণত হবে এটা প্রায় এক নিয়তির মতো। রাস্তাঘাট তৈরি, বাড়ি তৈরি, কলেজে শিক্ষাব্যবস্থা— এই সব সম্পদ সৃষ্টির এ হল এক ধরনের পরিণাম। এর বিরুদ্ধে সরকার দৃঢ় হবে, কিন্তু এ যেমন সম্পূর্ণ দূর হবে না, অন্য দিকে এই পরিণামে ভীত হয়ে সম্পদসৃষ্টিও বন্ধ করা যাবে না।

এই বাস্তবানুগ এবং ব্যাপক দৃষ্টিভঙ্গি শিক্ষিত সমাজের অধিকাংশ নেবেন, এ আশা না করাই ভাল। ভারতের মতো উত্তর-ঔপনিবেশিক দেশে সম্পন্ন মধ্যশ্রেণি, উচ্চবিত্ত এবং সামাজিক পুঁজিতে বলীয়ান খ্যাতিমানরা জনপ্রিয়তাবাদী সরকারের প্রতি বিরুদ্ধাচারণ করে যাবেন। তবু এ কথা বলা দরকার যে জনপ্রিয়তাবাদীদের অর্থনৈতিক সম্ভাবনা ক্ষীণ হলেও তার রাজনৈতিক সম্ভাবনা বিপুল। সেই সম্ভাবনা আজ পশ্চিমবঙ্গে সামাজিক পরিকাঠামো গড়ার কর্মসূচির মধ্যে প্রতিফলিত হচ্ছে। তাতে অনেক স্বার্থে ঘা পড়েছে।

পঞ্চাশ বছর আগে কলকাতা থেকে প্যারিস, বার্লিন থেকে ঢাকা, লাহৌর, করাচি পর্যন্ত আওয়াজ উঠেছিল: শিক্ষার সদর দফতরে কামান দাগো। এই স্লোগানের মধ্য দিয়ে শিক্ষা সংস্কৃতির একচেটিয়া অধিকারের বিরুদ্ধে ব্যাপক সামাজিক ক্ষোভ

যে ভাবে প্রতিফলিত হয়েছিল, তাকে কি অস্বীকার করা যাবে? (শেষ)

রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, মহানির্বাণ ক্যালকাটা রিসার্চ গ্রুপ

(রণবীর সমাদ্দারের লেখার প্রথম পর্বে (শিক্ষার প্রসার...’, ৩১-৭) চতুর্থ অনুচ্ছেদের একটি বাক্য মুদ্রিত হয়েছে এই ভাবে: অবশ্য অনেকে মনে করেন ‘উচ্চশিক্ষা’ বলে কিছু হয় না, ওটা সোনার পাথরবাটি।— ‘উচ্চশিক্ষা’ নয়, কথাটি হবে ‘উচ্চ গণশিক্ষা’। অনিচ্ছাকৃত এই ভুলের জন্য আমরা দুঃখিত ও ক্ষমাপ্রার্থী।)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Student Collage
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE