সন্ময় বন্দ্যোপাধ্যায়. —ফাইল চিত্র
নাগরিক অধিকার বস্তুটি এই দেশে ক্রমশ অবলুপ্ত হইবার পথে। এবং তাহা প্রমাণ করিতে ভারত সরকার ও পশ্চিমবঙ্গ সরকার যেন যুগপৎ মাঠে নামিয়াছে। সম্প্রতি সন্ময় বন্দ্যোপাধ্যায়কে কেন্দ্র করিয়া তৃণমূল কংগ্রেস শাসিত পশ্চিমবঙ্গে যাহা ঘটিয়া গেল তাহাকে আপত্তিকর বলিলে অত্যন্ত কম বলা হয়। এই রাজ্যের নাগরিক অধিকারভঙ্গের দীর্ঘ ইতিহাসেও সন্ময়-সংক্রান্ত ঘটনা একটি মাইলফলক হিসাবে চিহ্নিত থাকিবে। বাস্তবিক, কংগ্রেস নেতা সন্ময়বাবুর বিরুদ্ধে প্রশাসনের অভিযোগটি ঠিক কী, তাহা বোঝা দুষ্কর। যত দূর শোনা গিয়াছে, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, মুখ্যমন্ত্রীর ভ্রাতুষ্পুত্র তথা সাংসদ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় এবং শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়, এই তিন জনের বিরুদ্ধে তিনি কুকথা বলিয়াছেন বলিয়া তাঁহাকে অন্যায় ও কদর্য পদ্ধতিতে নির্যাতন করিয়া চলা হইতেছে। প্রশ্ন হইল: এই তিন জনই রাজ্য প্রশাসনের শীর্ষমুখ, কিন্তু তাই বলিয়া রাজ্যের প্রতিটি নাগরিককে তাঁহাদের সম্পর্কে বাধ্যতামূলক ভাবে সুবাক্য কহিতে হইবে, এ-হেন জবরদস্তি চলিতে পারে কি? যদি কেহ রাজনীতিগত ভাবে তাঁহাদের বিরোধী হন, এবং সে কথা সরবে প্রকাশ করেন, তাহাতে ওই ব্যক্তির অধিকার এই ভাবে ভঙ্গ করার অধিকার গণতান্ত্রিক প্রশাসনের থাকে কি? উক্ত ব্যক্তি তাঁহার বাক্য কিংবা কাজের দ্বারা নেতাদের সম্মানহানি করিয়াছেন, এমন অভিযোগ উঠিতেই পারে। কিন্তু তাহা উঠিলে যথাযথ আইনি পথে সেই অভিযোগের সত্যাসত্য বিচারের পদ্ধতি তো গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে থাকিবার কথা। যত ক্ষণ অবধি সেই বিচার অনুষ্ঠিত না হইতেছে, তত ক্ষণ অভিযুক্তের এ-হেন নির্যাতন যে ব্যবস্থায় চলিতে পারে, তাহার নাম গণতন্ত্র নহে। সত্য বলিতে, সন্ময়বাবু পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য প্রশাসন সম্পর্কে যে অভিযোগটি করিয়াছেন, প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের কাজকর্ম চিন্তাভাবনা বুঝাইয়া দিতেছে যে সেই অভিযোগে সত্যের ভাগ অনেকটাই। নতুবা এই যথেচ্ছাচার চলিতে পারিত না। নাগরিককে এমন নির্যাতন করা চলিত না।
বাক্স্বাধীনতার প্রশ্নে তৃণমূল সরকারের প্রবল অসহিষ্ণুতার নিদর্শন গত আট বৎসরে পশ্চিমবঙ্গ কম দেখে নাই। আশ্চর্য এই যে, বারংবার অসহিষ্ণুতার প্রশ্নে সমালোচিত হইয়া, রাজনীতিতে তাহার দাম চুকাইয়া, বিজেপির পাল্টা উত্থানের মুখে পড়িয়াও দল ও প্রশাসনের বিবিধ স্তরের চালকদের শিক্ষা হয় নাই। তাঁহারা এখনও কেবল বিরোধীদের কণ্ঠরোধ করিতে উদ্যত নহেন, নানা মামলায় কী ভাবে বিরোধী ব্যক্তিকে অপদস্থ করা যায়, সেই প্রতিশোধপরায়ণতায় মাতিতে ব্যস্ত। আপাতত সন্ময় বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে একের পর এক জামিন-অযোগ্য মামলা রুজু হইতেছে, যদিও অভিযোগগুলি সব একই ধাঁচের। যে কোনও বোধসম্পন্ন ব্যক্তি বলিবেন, প্রশাসন যদি মামলা করিতে চাহে, তবে একই গোত্রের অভিযোগগুলিকে একত্র করিয়া এক আদালতে মামলা করাই স্বাভাবিক কাজ। কিন্তু শিশির অধিকারীরা বোধ হয় ‘স্বাভাবিক’ বলিতে সুর চড়াইয়া যৎপরোনাস্তি ঝামেলা পাকানোই বোঝেন। তাই বলিতে পারেন, রাজ্যের সব থানাতেই এমন অভিযোগ হইবে, পাল্টা বলিবার থাকিলে আদালত আছে!
অসীম দুর্ভাগ্য ইহাই যে, এই জায়গাটিতে কেন্দ্রীয় সরকার ও রাজ্য সরকারের মানসিকতার অসামান্য মিল। কেন্দ্রীয় সরকার যে একের পর এক ভিত্তিহীন মামলা ঠুকিয়া তাহার বিরুদ্ধবাদীদের, এবং সমালোচকদের বিপন্ন করিবার চেষ্টা করিতেছে, তাহা সকলেই অবগত। পশ্চিমবঙ্গবাসীর ক্লেশের কারণ, তাহাদের বিপন্ন করিবার চেষ্টায় নামিয়াছে দুই সরকার, দুই দলের একই প্রকার অসহিষ্ণুতা। দুই পক্ষেই সেই একই স্পর্ধা, একই দুঃসাহস, নাগরিক অধিকারের প্রতি একই বিতৃষ্ণা। কী করিবেন রাজ্যবাসী? কোথায় যাইবেন প্রতিকারার্থে, প্রতি পদে? আদালতে?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy