Advertisement
E-Paper

দ্বিতীয় পর্বে এ এক অন্য মমতা

সিপিএমের এক প্রবীণ নেতা এ বার ভোট বিপর্যয়ের পরে বলেছেন, ‘আমাদের সমস্যা হচ্ছে, আমাদের দলে একটা মমতা নেই।’ লিখছেন জয়ন্ত ঘোষাল নবান্নে আবার প্রবেশ করেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।মমতার প্রথম পর্বের সঙ্গে দ্বিতীয় পর্বের বেশ কিছু ফারাক উল্লেখযোগ্য ভাবে নজরে আসছে।

শেষ আপডেট: ১৫ জুন ২০১৬ ০৬:১৯

নবান্নে আবার প্রবেশ করেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।

মমতার প্রথম পর্বের সঙ্গে দ্বিতীয় পর্বের বেশ কিছু ফারাক উল্লেখযোগ্য ভাবে নজরে আসছে। ক্ষমতায় আসার পর অবশ্য এখনও এক মাসও অতিবাহিত হয়নি। কাজেই এই আপাত পরিবর্তনগুলির ভিত্তিতে কোনও শেষ কথা বলার সময় এখনও আসেনি। কিন্তু পাঠকদের কাছে সেই আপাত পরিবর্তনগুলি তুলে ধরতে ইচ্ছা করছে।

প্রথমত, দ্বিতীয় বারের জন্য ক্ষমতাসীন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সল্টলেকে গণধর্ষণের ঘটনা ঘটে। সংবাদমাধ্যম মুখ্যমন্ত্রীর প্রতিক্রিয়া আশা করেছিল। মুখ্যমন্ত্রী কিন্তু কোনও কথা বলেননি। প্রকাশ্যে কোনও মন্তব্য না করলেও পুলিশ কমিশনারকে এবং সংশ্লিষ্ট প্রশাসনকে সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য নির্দেশ দেন। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে পুলিশ কয়েক জনকে গ্রেফতারও করে। এর আগের বার ক্ষমতায় আসার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই তিনটি ঘটনা বেশ মনে পড়ে। পার্কস্ট্রিটে গণধর্ষণ, যেখানে মমতার মন্তব্যকে ঘিরে প্রতিপক্ষ এবং সংবাদমাধ্যম উত্তাল হয়ে ওঠে। দ্বিতীয়, ভবানীপুরের বাস জ্বালিয়ে দেওয়ার ঘটনায় গ্রেফতার তৃণমূল কর্মীদের ছাড়াতে মুখ্যমন্ত্রী থানায় চলে গিয়েছিলেন। তৃতীয়, আমরি হাসপাতালে আগুন লাগার পর, হাসপাতালটিকেই বন্ধ করে দেওয়া এবং তাদের মালিকদের গ্রেফতার করা।

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে আমার এই বিষয় নিয়ে কোনও কথা হয়নি দ্বিতীয় দফায় মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর। কিন্তু অভিজ্ঞতা থেকে মানুষ শিক্ষালাভ করে। সম্ভবত মমতাও করছেন। বিরোধী নেত্রী হিসাবে মমতা ধর্ষণ এবং পুলিশি অত্যাচার— এ সবের বিরুদ্ধে বরাবর সোচ্চার ছিলেন। তিনি বরাবরই তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু তথা বামফ্রন্ট প্রশাসনের বিরুদ্ধে এ সব নিয়ে সোচ্চার হয়েছেন। বিরোধী নেত্রী হিসাবে সেটাই ছিল তাঁর কাজ। আর সেই জন্যই তো তিনি সফল হয়েছিলেন। সিপিএমের এক প্রবীণ নেতা এ বার ভোট বিপর্যয়ের পরেও আমায় বলেছেন, ‘‘আমাদের সমস্যা হচ্ছে, আমাদের দলে একটা মমতা নেই।’’ কিন্তু ক্যামেরার সামনে আর ক্যামেরার পিছনে দু’টি ভূমিকা যেমন ভিন্ন, ঠিক তেমনই ট্রেজারি বেঞ্চ আর বিরোধী শিবির, এই দু’টি ভূমিকাও কিন্তু বিপরীতধর্মী।

তখন মমতা সবে মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন। পার্ক স্ট্রিট ধর্ষণকাণ্ড আর আমরি-র অগ্নিকাণ্ড শেষ হয়েছে সবে। সেই সময় পটনায় গিয়েছিলাম নীতীশ কুমারের সঙ্গে দেখা করতে। নীতীশ কুমার আমাকে বলেছিলেন, ‘‘আমি তো ঘুম ভেঙে উঠে টিভি চালালেই দেখতে পাই বিহারে প্রতি দিন কমপক্ষে ৫ থেকে ৭টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। আমি কোনও প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করি না। ডিজি এবং পুলিশ কমিশনারকে ব্যবস্থা নিতে বলি। দু’-এক জনকে গ্রেফতার করা হলেই দুপুর একটা নাগাদ ডিজি-কে সাংবাদিক বৈঠক করে সেগুলি জানাতে বলি। টিভিতে দুপুর পর্যন্ত ধর্ষণ নিয়ে রাজ্য সরকারকে গালি দেওয়া হয়। আর দুপুরের পর পুলিশি ব্যবস্থা নিয়ে কভারেজ শুরু হয়।’’

প্রাকৃতিক দুর্যোগ নিয়েও নীতীশের অভিজ্ঞতা প্রণিধানযোগ্য। মুখ্যমন্ত্রী হতে না হতেই ব্যাপক বন্যা হয়েছে। বিহারে তো ফি বছর বন্যা হয়। দিল্লির একটি বৈদ্যুতিন চ্যানেল বিহারের বন্যা নিয়ে ২৪ ঘণ্টা ধরে ক্ষিপ্ত। নীতীশ বলছিলেন, ‘‘পর দিন সকালে সেই চ্যানেলের সম্পাদককে ফোন করে অনুরোধ করলাম। আমি হেলিকপ্টার নিয়ে বন্যা দেখতে বেরোচ্ছি যাতে এই দুর্যোগের মোকাবিলা করতে প্রশাসন সফল হয়। গরিব রাজ্য, তবু চপার ভাড়া নিয়েছি রাজ্যের মানুষেরই স্বার্থে। আপনিও আসুন আমার সঙ্গে, পরিস্থিতি নিজের চোখে দেখুন। সম্পাদক নিজে না এলেও এক প্রতিনিধি সাংবাদিককে পাঠালেন। সারা দিন ধরে বন্যা দেখা, হাতে হাতে প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেওয়া, এই সব চলতে থাকল। কয়েক দিনের মধ্যেই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এল। সে বছর ওই চ্যানেল সামাজিক সেবার জন্য, বিহার সরকারকে সফল ভাবে বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য বিশেষ সম্মান দিল।’’ এই সব ঘটনা বলে নীতীশ আমাকে বলেছিলেন, ‘‘দিদিকে বল, এত বেশি সংবেদনশীল না হতে। বিরোধী থাকার সময়ে আমরা সংবেদনশীল হই। কিন্তু শাসক হলে চামড়াটা গন্ডারের না হয়ে উপায় নেই।’’ নীতীশের এই কথার মধ্যে একটা তির্যক শ্লেষ ছিল আজকের এই রাজনৈতিক ব্যবস্থা এবং মিডিয়ার প্রতি। কিন্তু এটা দিল্লিতেও দেখেছি যে শাসক নেতা স্থিতাবস্থা ভেঙে নতুন কিছু করতে গিয়েছেন তিনিই কিন্তু বিপদে পড়েছেন। জ্যোতিবাবুর সিপিএম স্থিতাবস্থা বজায় রেখে কোনও বৈপ্লবিক কিছু না করে দীর্ঘ দিন ক্ষমতায় ছিল। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য পারেননি, কিন্তু অচলায়তন ভাঙার চেষ্টা করেছিলেন। নতুন সিপিএম তৈরির স্বপ্ন দেখেছিলেন। তাঁরও পতন হয়েছে। কাজেই রাজ্যের উন্নয়ন, বৈপ্লবিক ভাবে অভিমুখ পরিবর্তন— এগুলি আলোচনার ভিন্ন বিষয়। কিন্তু ভারতের রাজনীতিতে টিঁকে থেকে সফল হতে গেলে ম্যাকিয়াভেলি এবং কৌটিল্য, এই দুই ব্যক্তিত্বকে মনে মনে প্রণাম ঠুকে নাটকীয় ভাবে ব্যবস্থা বদলের চেষ্টা না করে ঘুণ ধরা দেওয়ালে চুনকাম করাই ভাল।

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর রাজনৈতিক ডিএনএ-তে বদল আনতে কতটা সক্ষম হবেন তা জানি না। আপাতত মনে হচ্ছে পশ্চিমবঙ্গে এ বার তিনি এসেছেন নবরূপে। যাকে বলে ‘নয়া অবতার’। বাকসংযম, আবেগপ্রবণ না হয়ে বুদ্ধি দিয়ে কৌশল রচনা করা, বিকেন্দ্রীকরণের নামে সাবেক আমলাতান্ত্রিক হায়ারার্কিতে নৈরাজ্য ডেকে না আনা এবং চামচাতন্ত্রকে কিঞ্চিৎ নিরাপদ দূরত্বে রাখা।

অবশ্য শেষ কথা বলার এখনও সময় আসেনি। পাঁচ বছরের সুদীর্ঘ মেনুতে এ তো সবে অ্যাপেটাইজার!

অপেক্ষা করুন, কোথাও যাবেন না। ফিরে আসব একটা ব্রেকের পর!

Mamata Banerjee tmc CPM CM
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy