Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

ক্লান্ত চোখে স্নিগ্ধ অঞ্জন

ভবতোষ সুতারের মতোই আর এক জনের কথা বলতে হয়। সে সনাতন দিন্দা। অত্যন্ত প্রতিভাবান শিল্পী। তার কাজও আমাকে ভীষণ মুগ্ধ করে। আমাদের পাড়ার কাজও সে করেছে। একটি পুজোয় এক বার মাটির ভাঁড় দিয়ে মণ্ডপ ও ভিতরকার সজ্জা করেছিল। তা প্রত্যক্ষ করে আমি আমার সহবিচারকদের সম্মত করে সেই পুজোটাকেই শ্রেষ্ঠত্বের শিরোপা দেওয়াই। কারণ, কল্পনাশক্তির ও রকম অভিনব স্বাক্ষর বিরল।

শীর্ষেন্দুু মুখোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ০৫ অক্টোবর ২০১৯ ০১:৪২
Share: Save:

ভিড়ের মধ্যে মিশে থাকলে আমি আত্মপরিচয় হারিয়ে ফেলি। মনে হয় আমি আর ব্যক্তিবিশেষ নেই, নামহীন জনতা। ভিড়ের চেয়েও ভয়প্রদ হল উত্তাল উচ্ছৃঙ্খল জনসমাবেশ, ঠেলাঠেলি, গুঁতোগুঁতি, ধাক্কাধাক্কি। এক সময়ে সে সব সয়ে কলকাতার পুজো দেখে বেড়াতাম বটে, কিন্তু মধ্যযৌবনে এসে মনে হল, আর না। পুজো যথেষ্ট দেখা হয়ে গিয়েছে। তবে আমার দু’টি শিশুসন্তানকে নিয়ে কাছেপিঠের দু’চারটে পুজো দেখিয়ে আনতাম। পুজোর ক’দিন সন্ধেবেলায় আর বাড়ির বাইরে বেরোতাম না। বইপড়া বা টিভি দেখা বা ছেলেমেয়ের সঙ্গে গল্প করে সময়টা চমৎকার কেটে যেত। দশ-বারো বছর বা তারও বেশি সময় কলকাতার পুজো দেখা হয়নি। কলকাতার পুজোর বিবর্তন কতটা হয়েছে তাও জানা ছিল না।

হঠাৎ একটি কোম্পানি থেকে পুজোর বিচারক হওয়ার অনুরোধ এল। প্রথমে খুব একটা আগ্রহ বোধ করিনি, তবে অনুরোধ উপরোধে শেষ পর্যন্ত রাজি হই। রাজি না হলে ঠকে যেতাম। বিশেষ গাড়িতে সওয়ার হয়ে কয়েক জন ভিআইপির সঙ্গে পুজোর বিচার করতে বেরিয়ে আমি বেবাক হাঁ হয়ে যাই। দশ-পনেরো বছরের মধ্যে পুজোর খোলনলচে সম্পূর্ণ পাল্টে গিয়েছে!

থিম পুজো অনেকেরই না-পসন্দ। আমার সেই শুচিবায়ু নেই। পেশাদার শিল্পীদের তৈরি মণ্ডপ আর মূর্তির যে সমারোহ দেখতে পেলাম, তা বিস্ময় ও মুগ্ধতা উদ্রেক করে। মনে আছে, প্রথম বার বিচারক হয়ে সন্ধে থেকে পর দিন ভোর পর্যন্ত বোধ হয় উত্তর দক্ষিণ মিলিয়ে কুড়ি-পঁচিশটা মণ্ডপে যেতে হয়েছিল। মাঝে নৈশভোজের জন্য আমাদের নিয়ে যাওয়া হয়েছিল এক রেস্তরাঁয়। আমি নিরামিষাশী শুনে রেস্তরাঁর কর্মকর্তাদের সে কী বিপন্ন অবস্থা! অবশেষে কী একটা নিরামিষ পদ যেন তৈরি করে দিয়েছিলেন তাঁরা। আজ আর তা মনেও নেই। শিল্পকর্মের বৈচিত্র দেখে শ্রান্তি-ক্লান্তি ভুলে গিয়েছিলাম। মনে আছে ভোর হওয়ার একটু আগে শেষ পুজোটা দেখতে দক্ষিণ কলকাতার একটি চওড়া গলিতে ঢুকে হতবাক হয়ে যাই। মণ্ডপ খাঁ খাঁ করছে। জনমানব নেই। কর্মকর্তারাও কেউ ছিল না। কিন্তু মূর্তি আর মণ্ডপ দেখে আমরা চিত্রার্পিত। অনেক মণ্ডপ ঘুরলে চোখ একটু ধাঁধিয়ে যায়, আমাদেরও তা-ই হয়েছিল। তার উপর আবার ঘুমে ঢুলুঢুলু চোখ। তবু আমাদের ক্লান্ত চোখকে যেন অদ্ভুত এক স্নিগ্ধ অঞ্জন পরিয়ে দিল শেষ পুজোটার মূর্তি আর মণ্ডপসজ্জা। আমরা ক’জন বিচারক একযোগে সেই পুজোটাকেই শিরোপা দিয়ে দিলাম। পরে সেই পুজোর কর্মকর্তারা আমার বাড়িতে এসে বিস্তর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে যান।

সেই শুরু, কিন্তু শেষ নয়। পরের বছরেই বোধ হয় আবার নৈশযাত্রা। নতুন নতুন চমকে চমৎকৃত। এ বার যেন গত বারকেও ছাপিয়ে গিয়েছিল আমার বিস্ময়। তার পর থেকে প্রায় নিয়মিত কোনও না কোনও প্রতিষ্ঠানের হয়ে পুজো পরিক্রমা করতে হয়েছে। তবে কিছু ক্ষেত্রে নির্বাচিত পুজোর সংখ্যা কঠোর ভাবে নিয়ন্ত্রিত থাকত। ছ’টার বেশি নয়। ফলে সময় লাগত কম এবং পরিশ্রম তেমন হতই না।

মনে আছে, এক সফরে এক মণ্ডপে গিয়ে থিম দেখে শিল্পীর কল্পনাশক্তিতে তাজ্জব হয়ে যাই। শিল্পী ভবতোষ সুতারের সঙ্গে পরিচয় হয়। আমি তাকে বলেছিলাম, তুমি আমাকে খুব চমকে দিয়েছ। এত অদ্ভুত প্রতিমা আর ভূতুড়ে মণ্ডপ আমি আর দেখিনি!

নানা বড় বড় ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান এবং কর্পোরেট হাউসও এখন পুজোয় পুরস্কার দেয়। তাদের অনেকের হয়েই আমাকে পুজোর বিচার করতে হয়েছে। অভিজ্ঞতা হয়েছে অনেক। গত কয়েক বছর যে কোম্পানির হয়ে পুজো দেখতে হয়েছে, তারা আবার সকাল থেকে পুজো পরিক্রমা শুরু করে। ফলে রাত জাগতে হয় না। তারা আবার মধ্যাহ্নভোজের জন্য নিয়ে যায় এক ঘ্যামা রেস্তরাঁয়। সেই রেস্তরাঁ আবার আমার নাড়িনক্ষত্র জানে এবং প্রতি বছর আমার জন্য আলাদা নিরামিষ রান্না করে রাখে, আলাদা টেবিলে সার্ভ করে।

ভবতোষ সুতারের মতোই আর এক জনের কথা বলতে হয়। সে সনাতন দিন্দা। অত্যন্ত প্রতিভাবান শিল্পী। তার কাজও আমাকে ভীষণ মুগ্ধ করে। আমাদের পাড়ার কাজও সে করেছে। একটি পুজোয় এক বার মাটির ভাঁড় দিয়ে মণ্ডপ ও ভিতরকার সজ্জা করেছিল। তা প্রত্যক্ষ করে আমি আমার সহবিচারকদের সম্মত করে সেই পুজোটাকেই শ্রেষ্ঠত্বের শিরোপা দেওয়াই। কারণ, কল্পনাশক্তির ও রকম অভিনব স্বাক্ষর বিরল।

দীর্ঘ দিনের এই সব অভিজ্ঞতা আমার অধরাই থেকে যেত, যদি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান আমাকে এই বিচারের ভার না দিত। ঘরে বসেই আমার পুজোর অবকাশ কাটত ভিড়ের ভয়ে। অনেক নতুন শিল্পী এই কাজে আসছেন, কলকাতার পুজোয় নতুন নতুন মাত্রা যোগ হচ্ছে। অনেক ছোটখাটো পুজোর পরিকল্পনাও আমাদের বিস্মিত করে তুলছে। আজকাল পুজোমণ্ডপে আগেকার মতো গাঁকগাঁক করে লাউডস্পিকার বাজানো হয় না, রুচিবোধের এই দৃষ্টান্তও অনুসরণীয়। তা ছাড়া লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে ধৈর্যের সঙ্গে সুশৃঙ্খল ভাবে পুজো দেখার অভ্যাসও মানুষের হচ্ছে। আর সেটা হচ্ছে পুজোর কর্মকর্তাদের নিরলস পরিশ্রম ও তত্ত্বাবধানের জন্য। এখনকার পুজোর এটা মস্ত ইতিবাচক দিক।

শনিপুজো, শীতলাপুজো, গণেশ বা জগদ্ধাত্রী পুজো উপলক্ষে কলকাতার অলিতে গলিতে, বস্তি অঞ্চলে লাউডস্পিকারের অত্যাচার এখনও অব্যাহত। কোনও অজ্ঞাত কারণে এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা করা হয় না। সে দিক দিয়ে দুর্গাপুজোয় কিন্তু শব্দের অত্যাচার অনেকটা কম।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Durga Puja2019 Shirshendu Mukhopadhyay
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE