Advertisement
১৮ মে ২০২৪

বয়সের নিদ্রাভাব

মানুষের ইতিহাসে অধিকাংশ সময় জুড়িয়া মানুষ দঙ্গল বাঁধিয়া ঘুমাইয়াছে, এবং দঙ্গলে নানা বয়সের মানুষকে রাখিয়াছে। হয়তো বয়স্ক মানুষদের কর্তব্য হিসাবে স্থির করা ছিল, রাত্রে, বা বিশেষত ভোরের সময়ে, যখন সাধারণত মানুষের নিদ্রা অধিক গাঢ় হইয়া উঠে, তখন সজাগ থাকিয়া, কোনও শিকারি জন্তু আসিয়া পড়িলে সে বিষয়ে সাবধান করিয়া দেওয়া।

বৃদ্ধবৃদ্ধাদের ঘুম কমিয়া যাওয়া প্রকৃতপক্ষে একটি বিবর্তনগত অভিযোজন।প্রতীকী ছবি

বৃদ্ধবৃদ্ধাদের ঘুম কমিয়া যাওয়া প্রকৃতপক্ষে একটি বিবর্তনগত অভিযোজন।প্রতীকী ছবি

শেষ আপডেট: ১৬ জুলাই ২০১৭ ০০:০০
Share: Save:

ব য়স্ক মানুষদের ঘুম কমিয়া যায় বলিয়া তাঁহারা নিয়মিত হাহাকার করেন। রজনী জুড়িয়া অস্বস্তি ভরিয়া শয্যায় বারংবার অবস্থান পরিবর্তন এবং দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ অতীব যন্ত্রণাময়, বিশেষত তাহা যখন এই জ্ঞান দ্বারা লাঞ্ছিত যে, বিশ্বের অন্য সকলেই মহা আড়ম্বরে ভোঁসভোঁস করিয়া গভীর নিদ্রায় মগ্ন। এই বার কিছু গবেষক এই সিদ্ধান্তে উপনীত হইলেন: বৃদ্ধবৃদ্ধাদের ঘুম কমিয়া যাওয়া প্রকৃতপক্ষে একটি বিবর্তনগত অভিযোজন, অর্থাৎ আদিম মানুষদের যে কোনও সমষ্টির মধ্যে অন্তত কয়েকটি মানুষ রাত্রে জাগিয়া থাকিবার যে প্রয়োজন ছিল, তাহা সাধিত করিতে করিতেই এই অভ্যাস ধীরে ধীরে জিনে খচিত হইয়াছে। মানুষের ইতিহাসে অধিকাংশ সময় জুড়িয়া মানুষ দঙ্গল বাঁধিয়া ঘুমাইয়াছে, এবং দঙ্গলে নানা বয়সের মানুষকে রাখিয়াছে। হয়তো বয়স্ক মানুষদের কর্তব্য হিসাবে স্থির করা ছিল, রাত্রে, বা বিশেষত ভোরের সময়ে, যখন সাধারণত মানুষের নিদ্রা অধিক গাঢ় হইয়া উঠে, তখন সজাগ থাকিয়া, কোনও শিকারি জন্তু আসিয়া পড়িলে সে বিষয়ে সাবধান করিয়া দেওয়া। তানজানিয়ার এক প্রাচীন জনজাতিকে লইয়া গবেষণাটি করা হইল, কারণ তাঁহাদের নিদ্রাভ্যাসের সহিত আদিম মানুষদের নিদ্রার ধরন মিলিয়া যায়। তাঁহারা ঘাস-নির্মিত কুটিরে অথবা বাহিরে প্রান্তরে ঘুমান, কোনও রূপ কৃত্রিম আলোক ব্যতীত, বিশ বা ত্রিশ জন মিলিয়া। তাঁহাদের ২২০ মিনিট নিদ্রা পর্যবেক্ষণ করিয়া (পর্যবেক্ষকরা উঁহাদের ঘিরিয়া বসিয়া থাকিতেন না, ওই জনজাতির প্রত্যেকের হাতে একটি করিয়া যন্ত্র পরাইয়া দেওয়া হইয়াছিল, যাহাতে এই তথ্যগুলি জানা যায়) দেখা যায়, মাত্র ১৮টি মিনিট এমন ছিল, যখন প্রত্যেকেই ঘুমাইয়া পড়িয়াছিলেন। বয়স্করা তাড়াতাড়ি ঘুমাইতে যাইতেন ও তাড়াতাড়ি উঠিয়া পড়িতেন, এবং বহু সময়েই হালকা ঘুমাইতেন। ফলে সিদ্ধান্ত হয়, বয়স্কদের অনিদ্রা বিবর্তনের এক আবশ্যক অঙ্গ।

যদিও ইহা জানিয়া কোন শান্তি মিলিবে, গবেষণার বিষয়। বিবর্তন হইবার কালে মানুষ বহু অভ্যাস আয়ত্ত করিয়াছিল। এখন মানুষ সম্পূর্ণ অন্য এক জীব। তখন সে বাঘের ভয়ে কাঁপিত, এখন বাঘ তাহার ভয়ে কাঁপে। কেহ বলেন, বিবর্তনের অভিযোজনের বশে মানুষ এখনও অন্ধকারে ভয় পায়, কারণ এক কালে অন্ধকার ঘনাইলে বন্য জন্তুরা মানুষকে মুখে তুলিয়া লইয়া যাইত। কিন্তু সেই ভয়কে প্রশ্রয় না দিয়া এখন অন্ধকারে সে সাহস করিয়া অগ্রসর হইবার চেষ্টা করে। হয়তো প্রাচীন কালে বয়স্ক মানুষেরা শিকারের ক্ষিপ্রতা হারাইয়া ফেলিতেন ও অকর্মঠ হইয়া পড়িতেন বলিয়া, তাঁহাদের স্কন্ধে প্রহরার দায় বর্তাইত। কিন্তু এখন সেই দায় তাঁহারা বহন করিবেন কেন? মানুষ কেবল প্রকৃতির বিরুদ্ধে গিয়া নিজ সভ্যতা গড়িয়া তুলিয়াছে তাহাই নহে। আপন প্রকৃতির বিরুদ্ধেও সে কম যায় নাই। বহু ক্ষেত্রে স্বতঃস্ফূর্ত লোভ দমন করিয়া ও স্বাভাবিক হিংস্রতাকে সংযত করিয়াই সে নিজেকে উচ্চতর আদর্শে নিষিক্ত করিয়াছে। তাহা হইলে নিদ্রার ক্ষেত্রে অভাবটিকে স্বভাবের অঙ্গ বলিয়া অকস্মাৎ মহিমাস্নাত হইবে কেন? বরং ইহাকে আপদ বলিয়াই মনে করিবে। প্রহরার জন্য দ্বারবান রহিয়াছে, নাইটগার্ড রহিয়াছে, গুহার পরিবর্তে সে কংক্রিটের সুরক্ষিত গৃহে, দরজা আঁটিয়া ঘুম দিতেছে। সিংহের ভয়ের খাজনা সে নিত্য রাত্রে চুকাইয়া খুশি থাকিবে?

বরং আবালবৃদ্ধবনিতা এখন কম ঘুমায়, কারণ কৃত্রিম আলোক আসিয়া তাহার দিনের দৈর্ঘ্য বহু গুণ বর্ধিত করিয়াছে, আর তাহার অবসরের উপকরণে বিস্ফোরণ ঘটিয়াছে। সূর্যাস্তের পর তাহার কাজ ফুরায় না, বরং তখনই প্রকৃত কাজ শুরু হয়। সে টিভি খুলিয়া বসে। বা ইউটিউবে ছোট ছবি দেখিয়া লয়। বা গান শ্রবণ করে। সমগ্র দিন অফিসের ও সমাজের কর্তব্য সারিয়া রাত্রে যন্ত্রনির্ভর আনন্দ শুরু করা আধুনিক সভ্যতায় মানুষের প্রধান শখ। নিজের পছন্দসই বই পড়িয়া ছবি দেখিয়া প্রবন্ধ হাঁটকাইয়া সে অধিক রাত্রে শুইতে যায়। ক্রমাগত এই সকল উত্তেজনা পোহাইতে পোহাইতে তাহার নিদ্রার ণত্ব-ষত্ব গুলাইয়া গিয়াছে। ঘুমপাড়ানি মাসিপিসি যদি বা তাহার পাড়ায় আসেন, চক্ষে বসিবার অবকাশই পান না। নিদ্রারও তো প্রস্তুতি রহিয়াছে, অভ্যাস রহিয়াছে, শৃঙ্খলা রহিয়াছে। বালিশে কাত হইয়া পড়িব আর নিদ্রা ক্রীতদাসের ন্যায় সেবা শুরু করিয়া দিবে, তাহা হইতে পারে না। অবশ্যই বয়স্কদের ঘুম কমিয়া যাওয়ায় বিবর্তনের ভূমিকা রহিয়াছে, কিন্তু অাধুনিক প্রযুক্তি ও বিশেষত সিরিয়াল ও তাহার ‘রিপিট’-এর ভূমিকা অধিক রহিয়াছে, সন্দেহ।

যৎকিঞ্চিত

সেন্সর বোর্ডের কাজ হল মাঝে মাঝেই সিনেমা নিষিদ্ধ করে লোককে উত্ত্যক্ত করা। অমর্ত্য সেনের ক্ষেত্রে তারা সে কাঁচি মোটে শিথিল করেনি। বড় মানুষ বলে তিনি অধিক ছাড় পাবেন কেন? যেমন সিন্ডিকেটের কিছু তালেবর, যারা জানে ‘যেখানে দেখিবে ভারা, তোলা তোলো বাধাহারা’, নেতাজির বাড়িকেও ছাড় দেয়নি। যে দেশে ভিআইপি দেখলেই সবাই গদগদ হাত কচলাতে ব্যস্ত, সেখানে এই কট্টর সাম্যবাদের নিরপেক্ষ ধর্ষকাম নির্ঘাত ভারতকে মহান করবে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Sleep Sleeping
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE