সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় এবং অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়
একই দিনে দুইটি খবর বাঙালিকে উল্লসিত করিল: অর্থনীতিতে অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়ের নোবেল জয় এবং বিসিসিআই-এর সভাপতি পদে সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের নির্বাচন। আম বাঙালির নিকট অর্থনীতি অনেকাংশেই দুরূহ, ক্রিকেট বরং সমীপবর্তী। গত কয়েক বৎসর যাবৎ সৌরভ বঙ্গ-ক্রিকেটের প্রধান প্রশাসক পদে বৃত, এখন সমগ্র ভারতে ক্রিকেট সংক্রান্ত যাবতীয় নীতি নির্ধারণের কান্ডারি হইলেন। বাঙালি একদা জীবনের সর্ব ক্ষেত্রে— জাতীয় তো বটেই, আন্তর্জাতিক স্তরেও— সমাদৃত ছিল। এখনও যে একেবারে নাই তাহা বলিলে ভুল হইবে, তবে ইদানীং রাজনীতি হইতে সাহিত্য, বিজ্ঞান হইতে ক্রীড়ার ময়দানে তাহার প্রতাপী প্রতিনিধিত্ব চোখে পড়িতেছিল কম। সৌরভের কীর্তি বাঙালিকে আরও এক বার বুক ফুলাইবার সুযোগ করিয়া দিল।
নানান দিক দিয়াই সৌরভের এই আরোহণ গুরুত্বপূর্ণ। ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের নিয়ামক সংস্থাটির ভাবমূর্তি গত কয়েক বৎসরে চরম ক্ষতিগ্রস্ত। ভূরি ভূরি দুর্নীতির অভিযোগ উঠিয়াছে, রাজনৈতিক ও দলীয়-উপদলীয় কোন্দলের ঘূর্ণিতে পঙ্কিল হইয়াছে ক্রিকেট-প্রশাসন। অবস্থা এমন হইয়াছিল যে সুপ্রিম কোর্টকেও হস্তক্ষেপ করিতে হয়। সর্বোচ্চ আদালত পৃথক প্রশাসক কমিটি গড়িয়া দিয়াছিল, তাহারই তত্ত্বাবধানে এত দিন দেশের ক্রিকেট-কর্মকাণ্ড চলিতেছিল। সৌরভ এখনও সভাপতি পদে কাজ শুরু করেন নাই, কিন্তু বলিয়াছেন, প্রধান-আসনে বসিয়া তাঁহার প্রথম কাজই হইবে বিসিসিআই-এর কার্যকলাপে স্বাভাবিকতা ফিরাইয়া আনা। সংস্থাটিতে এত কাল যে অনেক কিছুই ‘অস্বাভাবিক’ ছিল, তাহা বুঝিতে ক্রিকেট-বোদ্ধা হইতে হয় না। সাধারণ মানুষ এত কাল দেখিয়া আসিয়াছেন, বিসিসিআই-এর প্রধান ও অন্যান্য পদে প্রাক্তন খেলোয়াড়দের নহে, নেতা-মন্ত্রীদের জয়জয়কার। যেন ইহাই দস্তুর। এমন নহে যে রাজনীতিবিদ সুপ্রশাসক হইতে পারেন না। আবার প্রাক্তন খেলোয়াড় মাত্রেই দুর্দান্ত নীতি-নির্ধারক হইবেন, তাহাও নহে। কিন্তু ক্রিকেট মাঠের প্রতিটি তৃণাগ্রকে যিনি চিনেন, দুই দশকেরও বেশি সময় ক্রিকেটের সহিত যাঁহার প্রত্যক্ষ সংযোগ, তিনি যে অন্তত এক জন রাজনৈতিক নেতা অপেক্ষা এই খেলাটির কেন্দ্র ও পরিপার্শ্ব রন্ধ্রে রন্ধ্রে বুঝিবেন, তাহা সন্দেহাতীত।
তবু এত কাল তাহা হয় নাই। রাজনীতির কারবারিরাই বিসিসিআই কুক্ষিগত করিয়া রাখিয়াছিলেন। বিগত পঁয়ষট্টি বৎসরে সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ই একমাত্র ভারতীয় ক্রিকেটার, যিনি ক্রিকেট-প্রশাসনের সর্বোচ্চ পদটিতে আসীন হইবেন। সুনীল গাওস্কর বা শিবলাল যাদব একদা অন্তর্বর্তী সভাপতি হইয়াছিলেন, পঞ্চাশের দশকে সভাপতি হইয়াছিলেন ব্রিটিশ ভারতের হইয়া মাত্র তিনটি টেস্ট খেলা ভিজিয়ানাগ্রামের মহারাজা। ভারত এত দিন দেখিয়াছে, ক্রিকেটারদের কেরিয়ার-উত্তর দৌড় আঞ্চলিক কি জাতীয় স্তরে নির্বাচক, কিংবা কোচ হওয়া পর্যন্ত। সেই সব পদপ্রাপ্তির পিছনেও রাজনীতির জটিল অঙ্ক থাকিত। অনেকে সিঁদুরে মেঘ দেখিতেছেন, বিসিসিআই-সভাপতি সৌরভের নিকটতম সহকর্মীরাও এই ভারতের ক্ষমতাসীন রাজনীতিবিদদের বন্ধু-পরিজন। তবে বাঙালির প্রিয় ‘দাদা’ চ্যালেঞ্জ লইতে বরাবরই সিদ্ধহস্ত। আশা, ক্রিকেটের ময়দান হইতে রাজনীতির বলটিকে মাঠের বাইরে পাঠাইয়া তিনি কীর্তিমান হইবেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy