Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

অধ্যয়নং তপঃ?

ছাত্রদের দায়িত্ব অধ্যয়ন করা, এই ‘মন্ত্র’ বাল্যকালে শিখানো হইয়া থাকে। কিন্তু মন্ত্রে যে কথা বলা থাকে না, তাহা হইল শিক্ষা লাভ করিয়া কী হইবে।

প্রতীকী চিত্র।

প্রতীকী চিত্র।

শেষ আপডেট: ০৮ ডিসেম্বর ২০১৯ ০১:০১
Share: Save:

তৃতীয় হইয়াছে ভারত, এবং ক্রমশ উন্নয়নশীল। না, গর্বিত হইবার বিষয় নহে, সূচকটির ভিত্তি— ছাত্রছাত্রীদের উপর রাষ্ট্রীয় আক্রমণের হিসাব। একে তুরস্ক, দুইয়ে চিন। সাম্প্রতিক কালে উচ্চ-শিক্ষিত সম্প্রদায়কে হানিবার নিরিখে এই দুই দেশের পরেই আসিয়াছে ভারতের নাম। গত বৎসর সেপ্টেম্বর হইতে এই বৎসর অগস্ট অবধি তুরস্কে ৪৯, চিনে ২৭ এবং ভারতে ২২ বার রাষ্ট্রযন্ত্রের নিষ্পেষণ চলিয়াছে ছাত্রসমাজের উপর। এই তথ্য যে সংগঠন প্রকাশ করিয়াছে, তাহার নাম শুনিলেই বুঝা যাইবে, লেখাপড়া করা সম্প্রদায় ঠিক কতখানি বিপদের সম্মুখীন— স্কলার্স অ্যাট রিস্ক, অর্থাৎ বিপদগ্রস্ত গবেষককুল। প্রথম দুই দেশ দূরবর্তী, কিন্তু থার্ড বয় তো একান্ত আপনার, তাহাকে স্বীকার না করিয়া উপায় নাই। কী হইতেছে এই দেশে? গোড়ার কথাটি সম্ভবত এই যে, জাতীয় রাজনীতি যে অভিমুখে আগাইতেছে, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণ তাহার সমর্থক নহে, এবং উহা সরবে ঘোষণা করিতেও ছাত্রসমাজের দ্বিধা নাই। বস্তুত, এক বিপরীত স্রোত তৈয়ারি করিয়া উহাতে দেশের জনতাকে শামিল করা তাহাদের উদ্দেশ্য বলিলেও অত্যুক্তি হয় না। এই দিকে সামান্যতম বিরোধী স্বরও যে হেতু বর্তমান ভারত সরকারের পছন্দ নয়, ফলে বিপ্রতীপতার ধ্বজাধারীদের সহিংস উপায়ে নির্মূল করিতে তাহারা সর্বশক্তি প্রয়োগ করিতেছে। হইলই বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান! মণিপুর হইতে দিল্লি, পঞ্জাব হইতে রাঁচী যেখানেই সমালোচনা উঠিতেছে, সরকারের তরফে কড়া জবাবও তৈয়ারি।

অথচ ছাত্রসমাজের ধর্মই যে সমালোচনা, ইতিহাস কিন্তু তাহা বার বার দেখাইয়াছে। কয়েক দশক পিছাইয়া ১৯৬৮ সালের মে মাসের দিকে তাকাইলে দেখা যাইবে, সেই সময়ে ফ্রান্সের ছাত্রদের সহিত ফরাসি সরকারের কী অভূতপূর্ব এক সংঘাত বাধিয়াছিল। চলতি অর্থব্যবস্থা, সমাজব্যবস্থা ও মূল্যবোধের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করিয়াছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রেরা। তাহাদের আহূত ধর্মঘটে এত সংখ্যক জনতা যোগ দিয়াছিলেন যে সরকার পড়িয়া যাইবার আশঙ্কা ঘনাইয়াছিল। ধর্মঘটকে সক্রিয় ভাবে সমর্থন করিয়াছিলেন প্রায় এক কোটি শ্রমিক, দেশের অর্থনীতিও স্থবির হইয়া গিয়াছিল। বিপ্লব বা গৃহযুদ্ধ জাতীয় বিশৃঙ্খলার ভীতিতে জার্মানিতে পলায়ন করিতে বাধ্য হন তৎকালীন প্রেসিডেন্ট শার্ল দ্য গল। সাময়িক ক্ষত মেরামতে আন্দোলন রুখিয়া দেওয়া সম্ভব হইলেও সঙ্গীত-গ্রাফিতি-পোস্টার-স্লোগানে সারবার্তাটুকুর প্রভাব হইয়াছিল বিশ্বজনীন। ভিয়েতনামে চলমান যুদ্ধের বিরুদ্ধে ভয়ানক প্রতিবাদ করিয়াছিলেন মার্কিনরা। অনুরণন ধ্বনিত হইয়াছিল ব্রাজিলের সামরিক শাসনবিরোধী গেরিলা যুদ্ধে, উত্তর আয়ারল্যান্ডের সংঘর্ষে, মেক্সিকো সিটির গণহত্যায়। সমসময়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন নিয়ন্ত্রিত ইস্টার্ন ব্লকের দেশগুলিও উত্থানের সাক্ষী হয়। কমিউনিস্ট একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিরোধের প্রচেষ্টা দেখা যায় চেকোস্লোভাকিয়া, পোল্যান্ড, যুগোস্লাভিয়ায়। ডানে-বামে প্রতিবাদ কম পড়ে না— নূতন সুরের দীক্ষাদানে সর্বত্রই অগ্রপথিক হয় ছাত্রসমাজ।

ছাত্রদের দায়িত্ব অধ্যয়ন করা, এই ‘মন্ত্র’ বাল্যকালে শিখানো হইয়া থাকে। কিন্তু মন্ত্রে যে কথা বলা থাকে না, তাহা হইল শিক্ষা লাভ করিয়া কী হইবে। উচ্চশিক্ষার মূল কথাটি প্রচলিত বন্দোবস্তকে প্রশ্ন করিবার শিক্ষা। সেই শিক্ষা অবশিষ্ট সমাজে ছড়াইয়া দিবার অঙ্গীকারও বটে। স্থবিরতা ভাঙিবার ক্ষেত্রে ছাত্রসমাজের সেই ভূমিকায় রাষ্ট্রের ভীত হইবার কথা। অর্ধশতক পার করিয়া সমাজ পাল্টাইয়াছে, রাজনীতি পাল্টাইয়াছে। ছাত্রসমাজ কিন্তু পাল্টায় নাই— প্রশ্ন এবং বিদ্রোহ করিবার প্রবণতাটি ধরিয়া রাখিয়াছে। রাষ্ট্রের দণ্ডমুণ্ডের কর্তারা আজ নবতর অস্ত্রে সজ্জিত— ছাত্রদের কণ্ঠ অবদমন করিতে নূতন নূতন পদ্ধতি ব্যবহারে তাঁহারা ব্যস্ত। যে দেশে স্বৈরাচারী সরকার প্রতিষ্ঠিত, সেখানে অত্যাচারের মাত্রাটিও অধিক। ভারতে আজ যাহা হইতেছে— একমাত্র জরুরি অবস্থা ব্যতিরেকে— তাহাকে অভূতপূর্ব বলিতে সংশয় নাই। হয়রানির কৌশলগুলি নূতন না হইলেও মাত্রাটি নিশ্চিত ভাবে অ-পূর্ব। রাজধানীর রাজপথে বেপরোয়া লাঠিচার্জ, কাহাকেও বহিষ্কার, কাহারও আর্থিক সহায়তা বাতিল করা, কাহাকেও নিখোঁজ করিয়া দেওয়া— নিপীড়নের এই সব রূপের সহিত ভারত পরিচিত হইতেছে। রাষ্ট্রের এই অত্যুগ্র রূপের সামনেও যে প্রশ্ন করিবার অধিকারে অবিচল থাকিতেছে ছাত্রসমাজ, উহাই আজিকার প্রাপ্তি।

যৎকিঞ্চিৎ

অর্থমন্ত্রী পেঁয়াজ খান না, তা হলে পেঁয়াজের দাম বাড়লে তাঁর মাথাব্যথা থাকবে কেন? ছেলেরা সাধারণত ধর্ষিত হন না, তবে ধর্ষণের প্রতিকার নিয়ে ছেলেদের ভাবার দরকার কী? প্রতিবন্ধী যাত্রীকে তুলতে যদি ট্যাক্সি ড্রাইভার অস্বীকার করে, সেখানে উপস্থিত পুলিশ সেই নালিশ শুনবেন কেন, তিনি তো প্রতিবন্ধী নন? কুকুরকে বিষ দিয়ে মারা হলে মানুষের মাথাব্যথা কিসের, গাছ কুপিয়ে কেটে ফেললে অ-গাছ চেঁচাচ্ছে কেন? যত্ন করে স্বার্থ বুঝুন, তবেই স-অর্থ ভারতীয় জীবনযাপন সহজ হবে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE