Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

ফাগুয়ার রঙে এক দিন শ্রমিকের রক্ত মিশেছিল

আজ আর কোনও পরিসংখ্যানের উপর জোর দিতে হবে না। কারণ, খোলা চোখেই আমরা পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি, বর্তমান বাংলায় আমাদের শ্রমিক ভাইদের অবস্থানটা কোথায়! মে দিবসে লিখছেন আশিস ভট্টাচার্য ভারতে মে দিবস প্রথম পালিত হয় চেন্নাই-এ (মাদ্রাজ) লেবার কিষাণ পার্টি অব হিন্দুস্থানের উদ্যোগে। ১৯২৩ সালে। উদ্যোক্তা ছিলেন পার্টির বলিষ্ঠ নেতা সিঙ্গারা ভেলু চেট্টিয়ার।

প্রতীকী চিত্র।

প্রতীকী চিত্র।

শেষ আপডেট: ০১ মে ২০১৯ ০৬:১২
Share: Save:

ইফ উইন্টার কামস, ক্যান স্প্রিং বি ফার বিহাইন্ড?’ ওয়ার্ডস ওয়ার্থের সেই অসাধারণ কবিতার পঙ্‌ক্তিটি আজও মানুষকে মনে করিয়ে দেয় বসন্তের জন্য অধীর আগ্রহের কথা। একই সঙ্গে তার প্রতি আকুলতার কথা, তার আসার প্রতীক্ষায় দিন কাটানোর কথা। কারণ বসন্ত ঋতু হল ঋতুরাজ। তার আগমনে সারা জীবকুল আনন্দে উদ্বেল হয়ে ওঠে। বিশ্বের উত্তর গোলার্ধ্বের চিরাচরিত প্রাচীন প্রথা অনুযায়ী বসন্তকে বরণ করে নেওয়ার দিন মে মাসের প্রথমে। ওই দিন নানা রকমের পোশাক পরে নানা ধরনের বাদ্যযন্ত্র সহযোগে বর্ণাঢ্য উৎসবের মধ্য দিয়ে ঋতু বসন্তকে আবাহন করা হয়। ওই দিন বিশ্বের অনেক দেশে সরকারি ছুটির দিন হিসাবে ঘোষিত থাকে।

আমাদের দেশে ক্যালেন্ডার ইয়ারে ম্যান্ডেটরি ছুটি ঘোষণার দিন হল চারটি। ওই বাধ্যতামূলক ছুটিগুলির মধ্যে মে-ডে একটি। কিন্তু তা বসন্ত বরণের জন্য নয়, শ্রমিকদিবস হিসাবে। মার্কিনিদের মধ্যে অনেকেই মনে করেন ১ মে হল বসন্তবরণের দিন। আবার কেউ কেউ উপলব্ধি করেন শ্রমিক দিবস হিসাবে। কিন্তু সারা বিশ্বে এখন ১ মে দিনটিকে ‘আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস’ বলেই গণ্য করা হয়।

অবর্ণনীয় অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে দিনে ১৬ ঘণ্টা কাজ করতে করতে দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গিয়েছিল মার্কিন শ্রমিকদের। অসহায় অসংগঠিত শ্রমিকগণ তাদের প্রতি এই অন্যায় জুলুমের প্রতিবাদ জানাতে সংগঠিত হয়েছিল। তাই একতাবদ্ধ হয়ে যে দিন তারা গর্জে উঠল, সে দিন ছিল ১৮৮৬ সালের ১ মে। দিনে ৮ ঘণ্টা কাজের দাবিতে তারা ধর্মঘট করে সে দিন এবং বিশাল মিছিল করে শহরের রাস্তায় নামে। শিকাগো পুলিশের সঙ্গে শ্রমিক সংগঠনের খণ্ডযুদ্ধ বেধে যায়। শ্রমিকের রক্তে রক্তাক্ত হয়ে ওঠে আমেরিকার রাজপথ। কিন্তু শ্রমিকেরা তাদের দাবি থেকে একটুও সরে না এসে বৃহত্তর আন্দোলনের পথে পা বাড়ায়। এই ঘটনা সারা বিশ্বে আলোড়ন ফেলে দেয়। সারা বিশ্বের শ্রমিকগণ সংগঠিত হয়ে এই জঘন্য কাজের সমালোচনা করেন। শ্রমিকের রক্ত-শপথ নিয়ে সারা বিশ্বের শ্রমজীবী মানুষ সংগঠিত হয়। শ্রমিক সংগঠন বিশ্বে স্বীকৃতি লাভ করে ১৮৮৯ সালের ১ মে। সেই থেকে ওই দিনটি আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস হিসাবে পালিত হয়ে আসছে।

বেশির ভাগ আমেরিকাবাসী মে দিবসকে বসন্ত উদ্‌যাপনের দিন হিসেবেই ধরেন। আর বেশ কিছু মানুষ মে দিবসকে উপলব্ধি করেন আন্তর্জাতিক শ্রমদিবস হিসেবে। কারণ, বিশৃঙ্খলা এবং রক্তপাত এড়াতে মার্কিন সরকারের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট গ্রোভার ক্লেভলেন্ড বসন্ত উদ্‌যাপনের দিনের সঙ্গে যাতে শ্রমিক দিবস মিলে না যায়, তার জন্য একই দিনে দু’টি ভিন্ন বিষয়ের উদ্‌যাপন থেকে বিরত থাকেন। তাই মে-র প্রথম দিনটি নির্ধারিতই থাকে বসন্ত উদ্‌যাপনের দিন হিসাবে আর সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম উইকেন্ডকে ধরা হয় শ্রমিক দিবস হিসেবে। ওই দিন যুক্তরাষ্ট্রীয় ছুটির দিন হিসেবে ঘোষিত হয় ১৮৯৪ সালে।

দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯

ভারতে মে দিবস প্রথম পালিত হয় চেন্নাই-এ (মাদ্রাজ) লেবার কিষাণ পার্টি অব হিন্দুস্থানের উদ্যোগে। ১৯২৩ সালে। উদ্যোক্তা ছিলেন পার্টির বলিষ্ঠ নেতা সিঙ্গারা ভেলু চেট্টিয়ার। তাঁর ব্যবস্থাপনা অনুসারে তখনকার মাদ্রাজের দু’টি ভিন্ন স্থানে উদ্‌যাপিত হয় শ্রমিক দিবস। এর পর ১৯৪৮ সাল থেকে সরকারি ভাবে ভারতে সারা বিশ্বের শ্রমজীবীদের মর্যাদা দিতে ১ মে বাধ্যতামূলক ছুটির দিন ঘোষণা করা হয়।

তা হলে কি আমরা ধরে নেব বর্তমান প্রজন্ম মে দিবসকে দেখবে একটা ম্যান্ডেটরি ছুটির দিন হিসেবেই। হয়তো বা তাই। এ ব্যাপারে আজ আর কোনও পরিসংখ্যানের উপর জোর দিতে হবে না। কারণ খোলা চোখেই আমরা পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি, বর্তমান বাংলায় আমাদের শ্রমিক ভাইদের অবস্থানটা কোথায়। প্রথমত, সংগঠিত শ্রমিকেরা আজ কোথায়? শ্রমিক-দরদি মুখোশের আড়ালে কোম্পানি মালিকদের সঙ্গে আর্থিক এবং সামগ্রী লেনদেনকারী ইউনিয়নের নেতাদের নৈতিক চরিত্র আজ দিনের আলোর মতো পরিষ্কার। তাঁদের অকৃপণ দয়ায় আজ বহু কারখানা বন্ধ। বহু জুট মিলের দরজা আজও খোলেনি। আদৌ খুলবে কি না, তার আশ্বাস কেউ দিতে পারছে না। অসহায় ভুখা শ্রমিকদের একটা অংশ আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছেন। দ্বিতীয়ত, শ্রমিক সংগঠনগুলি এখন কী করছে? নামকাওয়াস্তে শ্রমিক সংগঠনগুলি আজ আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলগুলির দ্বারা প্রভাবিত হয়ে শ্রমিক-স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে রাজনৈতিক দলের স্বার্থ চরিতার্থ করায় নেমেছেন। রাজনৈতিক নেতারাও ভোটের দামামা বাজলেই এঁদের দিয়ে কিছু ফায়দা তোলার চেষ্টা করেন।

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিস্থিতি অনেকটাই বদলেছে। একশো তিরিশ বছর পেরিয়ে যাওয়া অতীতের সেই ঘটনার পুনরাবৃত্তির সম্ভাবনা হয়তো আজ আর নেই। সারা বিশ্বে দৈনিক ৮ ঘণ্টার কাজ নির্ধারিত হয়েছে বহু দিন। এখন আর শ্রমিকদের মূল্য কোথায়? যন্ত্রদানব এসে সব গ্রাস করে নিয়েছে। নিত্যনতুন প্রযুক্তির উদ্ভাবনে এখন দালালের সংখ্যা বাড়ছে। কোথায় সোশ্যালিজ়ম-কমিউনিজ়মের আদর্শ? বর্তমান প্রজন্ম সব তছনছ করে বেড়ে উঠছে এক ভিন্ন আদর্শ নিয়ে। বাঁচতে গেলে চাই অনেক টাকা— সে নিজের ক্ষমতায় হোক বা পরকে মেরে হোক। সামান্য খাওয়া-পরার সমস্যা মেটাতে কেউ রোজগার করে না। রোজগার হল আনুসঙ্গিক খরচ বহন করার জন্য, দেনা(ইএমআই) মেটানোর জন্য।

জীবনযাত্রার ধরন পাল্টে যাওয়ায় এক জন আমেরিকান শ্রমিককে স্টেটাস বজায় রাখতে একই দিনে তিনটি কর্মস্থলে কাজ করতে হয়। সেখানে আর ঘণ্টার হিসেব থাকে না। ধর্মঘট আজ মূল্য হারিয়েছে। প্রতিবাদ জানাতে হলে তা কর্মরত অবস্থায় ব্যাচ ধারণ করে জানাতে হয়। কর্মনাশা কর্মবিরতি কে চায়? সপ্তদশ লোকসভা নির্বাচনে তাই মূল্যবৃদ্ধি, বেকারি, দারিদ্র্য ও স্বৈরাচারের বিষয় নিয়ে পথে নামতে হয়েছে বামপন্থী রাজনীতিকদের। খেত খামারে কাজ নেই। যখন বাধ্য হয়ে তারা আত্মহননের পথ নিচ্ছে, তখন কৃষক-দরদি কেন্দ্রীয় সরকার কুম্ভীরাশ্রু মোচন করে নয়া কৌশলী প্রকল্প আনছেন ভোট বৈতরণী পার হতে।

খবরে প্রকাশ, ২৭টি রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা-সহ কয়েক হাজার কারখানায় এখন তালা ঝুলছে। সে তালা খোলার চাবি কার পকেটে আছে তা নিয়েও চলেছে ভোটরঙ্গ। এর সঙ্গে জুটেছে ‘দেশপ্রেম’। কলকারখানার শ্রমিকদের হকের লড়াইয়ে পাশে থেকে এক দিন যাঁরা মূলধন কামালেন, তাঁরাই দিলেন শ্রমিককে নির্বাসন! এই আঞ্চলিক চরিত্রহীন মুখোশধারী নেতাদের আনুকূল্যে আজ যা বাড়ছে, সেই নিয়েই সমস্যা করছেন দলীয় নেতৃবৃন্দ। শিশুশ্রম লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। পুলিশ তোলা-আদায়ে ব্যস্ত। আর নতুন প্রজন্ম শুধু আট ঘণ্টা কেন, ঘণ্টার পর ঘণ্টা খেটে যেতেও আজ প্রস্তুত। তারা তাদের জীবন, যৌবন, সংসার, সামাজিকতা— সমস্তই বাঁধা রাখছে কর্পোরেটদের কাছে। তার ছোট্ট পরিবারটিকে স্বপ্ন-সুরভিতে ভরিয়ে রাখতে তারা বিকিয়ে দিচ্ছে নিজেকে।

তাদের মতে, হয়তো আর কোনও রেড মার্চ নয়, ক্যালেন্ডারের লাল কালির ওই দিনটি ১ মে একটি ম্যান্ডেটরি ছুটির দিন। সর্বহারাদের ছবি আর নয়, ওটা না হয় থাকুক ড্রইংরুমের দেওয়ালে অ্যান্টিক ভ্যালু নিয়ে।

আজ বরং পরিকল্পনা করা যেতেই পারে— এই ছুটিটা কোন রিসর্টে কেমন ভাবে চুটিয়ে উপভোগ করা যায়!

লেখক অবসরপ্রাপ্ত সাংবাদিক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE