Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
গ্রামে ডাক্তারি করতে চান না? তা হলে মোটা টাকা ধরে দিন

সাম্য সুযোগের, অধিকারের

দুটো পথেই নিজেদের স্বাধীনতা কিনবে ছাত্ররা— পড়া শেষে গ্রামে গিয়ে অপছন্দের চাকরি না করার স্বাধীনতা।

অমিতাভ গুপ্ত
শেষ আপডেট: ২৮ জুলাই ২০১৮ ০০:০০
Share: Save:

কলকাতার ডাক্তাররা গ্রামে আসেন না। কেন আসেন না, তার লম্বা ফিরিস্তি ডাক্তারবাবুদের কাছে আছে। গ্রামে-মফস্সলে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে পরিকাঠামো নেই, একটা ওষুধ অবধি পাওয়া যায় না, অথচ রোগীর কিছু হয়ে গেলে ডাক্তারের জীবন নিয়ে টানাটানি পড়ে। এই কথাগুলো গ্রামের মানুষও কমবেশি জানেন। কিন্তু এটা সম্ভবত জানেন না, পাশ করা ডাক্তাররা গ্রামে না যেতে চাইলে সরকারের ঘরে মোটা টাকা জমা করলে তবে ছাড় মেলে। তার নাম বন্ড। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের চাপিয়ে দেওয়া এই বন্ডের নিয়মে আদালত স্থগিতাদেশ দিয়েছে, সে খবরও সম্ভবত পৌঁছয় না তাঁদের কাছে। তাঁরা জানেন, পাশ করা ডাক্তার তাঁদের কপালে নেই, হাতুড়েই ভরসা।

এই জানা, এবং মেনে নেওয়ার মধ্যে ঘোর অসাম্য আছে। শহর আর গ্রামের অসাম্য। গ্রামের মানুষ বলেই কারও বিজ্ঞানসম্মত চিকিৎসার অধিকার থাকবে না, সভ্য সমাজের পক্ষে এই কথাটা মানা কঠিন। সরকারের পক্ষেও, কারণ ভোট তো চাইতে হবে। ডাক্তাররা যদি স্বেচ্ছায় গ্রামে না যেতে চান, তাঁদের বাধ্য করা ছাড়া আর উপায় কী? কুড়ি লক্ষ টাকার বন্ডের ব্যবস্থার পিছনে এটাই যুক্তি। যুক্তিটাকে উড়িয়ে দেওয়া মুশকিল। রাজ্য সরকার কী ভঙ্গিতে সেই কাজ করছে, আদালতের নির্দেশের সঙ্গে তার বিরোধ আদালত অবমাননা কি না— সেই তর্কে ঢুকব না। বন্ডের ব্যবস্থাটা ন্যায্য কি না, আপাতত সেই প্রশ্নটুকুই আলোচ্য।

সব চেয়ে চালু যুক্তি হল, যে হেতু ডাক্তারি পড়ার খরচের সামান্য অংশই ছাত্রদের পকেট থেকে আসে, বাকিটা সরকার ভর্তুকি বাবদ দেয়, ফলে সরকারের অধিকার আছে পড়া শেষে ছাত্রদের দিয়ে গ্রামে কাজ করিয়ে নেওয়ার। ডাক্তাররাও পাল্টা আপত্তি করেন— সব সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানই তো ভর্তুকিতে চলে। তা হলে কেন আর কাউকে জোর করে অপ্রিয় কাজে জুতে দেওয়া হয় না, শুধু ডাক্তারদেরই গ্রামে পাঠানো হয়? এই প্রশ্নের উত্তর তুলনায় সহজ। কোনও গ্রামে এক জন অর্থনীতিবিদ বা ভূতাত্ত্বিকের প্রয়োজন যত, এক জন ডাক্তারের প্রয়োজন তার বহু গুণ। যারা ডাক্তারি পড়তে আসে, তারা এই কথাটা জেনেই আসে। সিদ্ধান্তটা সচেতন, ফলে তার দায় অস্বীকার করার কোনও উপায় নেই।

বরং, জোরালো আপত্তি হতে পারে অন্য। কোনও ছাত্র বলতেই পারে, আমার ভর্তুকির প্রয়োজন নেই, আমি পুরো টাকা দিয়েই পড়তে রাজি ছিলাম। কিন্তু, সরকারি কলেজে সেই সুযোগ ছিল না। যে ভর্তুকি আমি চাইনি, সেই ভর্তুকি দিয়ে আমায় গ্রামে পাঠানোর মানে, আমার কাছ থেকে জোর করে জীবনের পথ নির্বাচনের স্বাধীনতা কে়ড়ে নেওয়া। আপত্তিটা জোরদার, কারণ সত্যিই কোনও অকাট্য কারণ ছাড়া কাউকে তার স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত করা অন্যায়। গ্রামে যেতে তার অনীহা কেন, এখানে সেই প্রশ্নটা ওঠে না, কারণ পেশার ক্ষেত্র বাছাইয়ের স্বাধীনতা যদি থাকে, তা হলে সেই স্বাধীনতাকে প্রশ্নাতীত হতে হবে। গ্রামে যেতে অনীহার কারণ সন্ধান না করে বরং জোর করে গ্রামে পাঠানো নিয়ে আপত্তির সমাধানসূত্র খোঁজা ভাল।

এই আপত্তির দু’রকম কাটান আছে। প্রথম ব্যবস্থা হল, ডাক্তারি পড়ার খরচের চরিত্রকে বদলে দিল সরকার। ছাত্রপিছু যত টাকা খরচ, ঠিক তত টাকাই আদায় করা হল। ভর্তুকির ব্যবস্থাও থাকল, কিন্তু শুধু তাদের জন্য, যাদের প্রয়োজন। অর্থাৎ, আর্থিক ভাবে পিছিয়ে থাকা ছাত্রছাত্রীদের জন্য। যে ছাত্ররা বিনা ভর্তুকিতে পড়ল, পড়া শেষে গ্রামে যাওয়ার কোনও বাধ্যবাধকতা থাকল না তাদের। আর যারা সরকারি ভর্তুকি নিল, গ্রামে যাওয়া তাদের জন্য বাধ্যতামূলক হল। পশ্চিমবঙ্গ সরকার যে বন্ড চালু করতে চাইছে, সেটা দ্বিতীয় ব্যবস্থা। গ্রামে যেতে না চাইলে ফিরিয়ে দিতে হবে ভর্তুকির টাকা। প্রশ্ন হল, এই দু’টি পথের কোনও একটা বেছে নেওয়া হলেই কি আর কোনও অন্যায় থাকবে না?

দুটো পথেই নিজেদের স্বাধীনতা কিনবে ছাত্ররা— পড়া শেষে গ্রামে গিয়ে অপছন্দের চাকরি না করার স্বাধীনতা। তবে, ফারাকও আছে পথ দুটোর মধ্যে। পড়ার সময়েই পুরো টাকা দিতে হলে নির্ভর করতে হবে পরিবারের আর্থিক সচ্ছলতার ওপর। শিক্ষাঋণ আছে, কিন্তু এখনও যে হেতু গ্যারান্টি দেওয়ার লোক না থাকলে ঋণ পাওয়া কঠিন, ফলে নিতান্ত গরিব পরিবারের ছেলেমেয়েদের পক্ষে বড় অঙ্কের শিক্ষাঋণ পাওয়া দুষ্কর। অন্য দিকে, পড়ার শেষে টাকা দিতে হলে— বিশেষত, কিস্তিতে দেওয়ার ব্যবস্থা থাকলে— যে কোনও ছাত্রের পক্ষেই বন্ডের টাকা মিটিয়ে দেওয়া সম্ভব। অন্তত, সম্ভাবনা বেশি। কিন্তু, সেই পার্থক্যের কথা মাথায় রাখলেও, টাকা দিয়ে স্বাধীনতা কেনা গেলে তার পাল্লা যে অবস্থাপন্ন পরিবারের ছেলেমেয়েদের দিকেই ঝুঁকে থাকবে, সেটা সন্দেহাতীত।

সরকার আদৌ এই স্বাধীনতা বিক্রি করতে পারে কি না, সেটা দীর্ঘ তর্ক। আপাতত ধরে নেওয়া যাক, স্বাধীনতা বিক্রিতে কোনও নৈতিক আপত্তি নেই। কিন্তু, ভর্তুকির টাকা ফিরিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে স্বাধীনতা কেনা— এই লেনদেনের পাল্লা যে হেতু ব়ড়লোকদের দিকে ঝুঁকে, সেখানে নৈতিক আপত্তি উঠবেই। প্রশ্ন উঠবে, গরিব আর্থিক ভাবে রাষ্ট্রের ওপর নির্ভর করতে বাধ্য হয় বলেই কি রাষ্ট্রও তার জন্য সুযোগের অসাম্য তৈরি করতে পারে?

স্বাধীনতা কেনার অধিকার সবার সমান, কারণ বন্ডের টাকাটা ধরে দিলেই মুক্তি— এই যুক্তি পেশ করে খুব লাভ হবে না। কারণ, টাকা দিয়ে স্বাধীনতা কেনার সুযোগের সাম্য আসলে শুধু খাতায়-কলমেই। টাকা না থাকলে সুযোগও নেই, সাম্যও নেই। সত্যিই যদি সুযোগের সাম্য তৈরি করতে হয়, তবে তা এমন ভাবে করতে হবে, যাতে গরিব-বড়লোক, উচ্চবর্ণ-নিম্নবর্ণ, গ্রাম-শহর, ছেলে-মেয়ে বা এই রকম অন্য কোনও প্রাথমিক ফারাক সেই সাম্যে প্রভাব না ফেলতে পারে।

বা, বড়লোক যদি স্বাধীনতা কেনার অধিকার পায়, তবে সেই স্বাধীনতা বাবদ লাভের একটা তাৎপর্যপূর্ণ অংশ যাতে গরিবের হাতে আসে, তা নিশ্চিত করতেই হবে। ধরা যাক, বন্ডের টাকা মিটিয়ে যারা স্বাধীন হবে, তারা সবাই শহরের বড় বেসরকারি কর্পোরেট হাসপাতালেই চাকরি করবে। প্রাইভেট প্র্যাকটিসও। তাতে প্রচুর টাকা। তার সঙ্গেই শহরে থাকার হরেক সুবিধে, এবং গ্রামে থাকার অসুবিধেগুলো থেকে মুক্তি। এই পুরোটা হল স্বাধীনতা বাবদ লাভ। যে গরিব ছাত্রটি বন্ডের টাকা জোগাড় করার অক্ষমতায় গ্রামে চাকরি করতে গেল, তাকে এই লাভের ভাগ দেওয়ার পথ তৈরি করতে পারলে তবেই বন্ডের ব্যবস্থাটি ন্যায্য হবে। সেই ভাগ দেওয়ার একটা পথের কথা বলব।

সরকার যে কুড়ি লক্ষ টাকার বন্ড চালু করেছে, ধরা যাক, তার পুরোটাই ভর্তুকি বাবদ খরচ হওয়া টাকা। পাশ করার পর কেউ গ্রামে যেতে না চাইলে এই টাকাটা ফিরিয়ে নিতেই হবে, কারণ জনগণের টাকায় তাকে পড়ানোর পিছনে সরকারের যে উদ্দেশ্য ছিল, সেটা পূরণ হল না। কিন্তু, এখানেই শেষ নয়। তৈরি করতে হবে বন্ডের দ্বিতীয় ভাগ। যে ছাত্রটি পাশ করেই শহরে চাকরি করতে আরম্ভ করল, আর যে বাধ্য হয়ে কয়েক বছরের জন্য গ্রামে গেল, তাদের দু’জনের জীবনের মোট উপার্জন ও আনন্দের মধ্যে টাকার অঙ্কে কতখানি ফারাক হয়? সেই হিসেবটা কষতে হবে। ধরা যাক, আজকের তারিখে গোটা জীবনের ফারাকের পরিমাণ ৬০ লক্ষ টাকা। তা হলে শহরে কাজ করতে পারা ডাক্তার যদি গ্রামে কাজ করতে বাধ্য হওয়া ডাক্তারকে এই টাকার অর্ধেকটা দেয়, তা হলে আর প্রাথমিক অবস্থার কারণে স্বাধীনতা কিনতে পারা-না পারার প্রভাব তাদের জীবনে পড়ে না। সেটাই নৈতিক অবস্থান।

অর্থাৎ, এই হিসেবে, বন্ডের পরিমাণটা দাঁড়ানো উচিত মোট ৫০ লক্ষ টাকায়। তার মধ্যে ২০ লক্ষ টাকা ফিরে যাবে রাজকোষে, আর বাকি ৩০ লক্ষ টাকা যাবে এক তহবিলে, যেখান থেকে গ্রামে কাজ করা ডাক্তারদের বেতনের সঙ্গে যোগ হবে একটা বাড়তি অংশ। গোটা জীবন ধরে। তারা গ্রামের কাজের পালা সেরে শহরে ফিরে আসার পরও।

আর, যে ছাত্ররা সত্যিই গ্রামে গিয়ে কাজ করতে চায়? খানিক বাড়তি টাকা পেলে তারা বোধ হয় আপত্তি করবে না। আর, আপত্তি থাকলে? টাকাটা ফিরিয়ে দিলেই হল।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Medical Health Doctors
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE