শব্দটি বহু-ব্যবহারে জীর্ণ, কিন্তু দুই হাজার আঠারো সালের ছয় সেপ্টেম্বরকে ‘ঐতিহাসিক’ না বলিলে অন্যায় হইবে। দেশের সর্বোচ্চ আদালতের সমকামিতা বিষয়ক রায়টি অবস্থান ও বক্তব্যের দিক দিয়া, ভাব ও ভাষার দিক দিয়া সর্বার্থেই ইতিহাস রচনা করিল। সমকামিতা যে দেশের সংবিধান অনুসারে কোনও ভাবেই ‘অপরাধ’ হইতে পারে না, সুপ্রিম কোর্টের পাঁচ বিচারপতি সমস্বরে তাহা ঘোষণা করিলেন। ঘোষণা করিলেন যে, ইহা কোনও আইনগত খুঁটিনাটির প্রশ্ন নহে, ইহা সংবিধানকে মান্যতা দিবার প্রশ্ন। যে সংবিধান ব্যক্তির অধিকার মানিয়া চলিবার অঙ্গীকার করে, তাহার আওতায় থাকিয়া কোনও রাষ্ট্র ব্যক্তির নিভৃততম অধিকারটি অস্বীকার করিতে পারে না— তাহা যৌনতাই হউক বা মানস-সম্পর্কই হউক। এ দেশে যে এত দিন অবধি ৩৭৭ ধারার মতো এমন একটি অনৈতিক বিধি চলিয়া আসিয়াছে, তাহা দুঃখজনক। নাগরিক অধিকার মান্য করিলে সমকামী যৌনতা অপরাধ বলিয়া গণ্য হইতে পারে না। সংবিধানের প্রতি মান্যতা রাখিবার কথা সুপ্রিম কোর্টের বহু রায়েই থাকে, কিন্তু যে বলিষ্ঠতার সহিত তাহা এই রায়ে উচ্চারিত হইয়াছে, নিশ্চিত ভাবে তাহাকে দুর্লভ বলা যায়। কেবল সক্রিয় এলজিবিটি গোষ্ঠীসমূহ নয়, কেবল সামাজিক অনুশাসনের ধাক্কায় জর্জরিত নিভৃতচারী সমকামী নাগরিক নহে, নাগরিকের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত ও সুরক্ষিত করিতে চাহেন, এমন সকল ব্যক্তিকে এই রায় আশ্বস্ত করিবে।
ব্যক্তিগত পরিসর লইয়া একটি রায় ইতিপূর্বে সুপ্রিম কোর্ট দিয়াছিল, যাহা হইতে ৩৭৭ ধারার অসাংবিধানিকতার প্রশ্নটি স্বভাবতই উঠিয়া আসে। ভারতীয় আইনবিধিতে যে কয়েকটি ধারা লজ্জাজনক ভাবে ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রব্যবস্থার উত্তরাধিকার বহন করে, ৩৭৭ তাহাদের অন্যতম। আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় ব্যক্তিগত অধিকার ও মর্যাদার এত বড় হানি থাকিতে পারে না। ঠিক এই কথাটিই শোনা গিয়াছিল ২০০৯ সালে দিল্লি হাই কোর্টের রায়টির মধ্যে, যেখানে প্রথম বার সমকামিতাকে অপরাধ গোত্রবহির্ভূত করিবার সিদ্ধান্ত ছিল। তাহার পর হাই কোর্টের রায়টি সামাজিক সংস্কার, তর্কবিতর্ক ও পরস্পরবিরোধিতার গোলকধাঁধায় পথ হারায়, সুপ্রিম কোর্ট ২০১৩ সালে হাই কোর্টের রায়টিকে বাতিল করে, তবে একই সঙ্গে সংসদকে এই বিষয়ে সংশোধনী বিল আনিবার প্রেরণা দেয়। কিন্তু সনাতন ভারতের মহামান্য সাংসদমণ্ডলী ন যযৌ ন তস্থৌ। অতঃপর কেন্দ্রে এনডিএ সরকার। কংগ্রেস সাংসদ শশী তারুর সংসদে ব্যক্তিগত বিল আনিলে বিজেপি সাংসদদের ভর্ৎসনা ও পরিহাস সীমা ছাড়াইয়া যায়— নাগরিক অধিকারের ইতিহাসে যাহা একটি কৃষ্ণ-মুহূর্ত। তবে বাধা অনেক সময়েই আন্দোলনকে জোর দেয়। এলজিবিটি গোষ্ঠী যে ক্রমেই আরও দৃপ্ত কণ্ঠে নিজেদের অধিকার দাবি করিতে পারিল, তাহা নাগরিক অধিকারের ইতিহাসে স্মরণীয়।
সুতরাং, এত দিন দেশে লিঙ্গভিত্তিক সম্পর্ককে যে ভাবেই দেখা হইয়া থাকুক, বিষয়টির নূতন স্বীকৃতি আবশ্যিক, ভারতের সাংবিধানিক অধিকারের প্রত্যাশিত ও স্বাভাবিক এই সম্প্রসারণটি ভারতের অধিকার-আন্দোলনের ইতিহাসে একটি বিজয়মুহূর্ত হইয়া রহিল। তৃতীয় লিঙ্গের স্বীকৃতি ইতিমধ্যে গতানুগতিক যৌনতার ধারণাকে পাল্টাইয়া দিয়াছে, সমকামিতার রায় তাহারই অনুসরণ। সর্ব শেষে, সামাজিক প্রচলনের যুক্তি, সংখ্যাগরিষ্ঠ-মতের যুক্তি কিংবা গণভোটের পদ্ধতি, কিছু দিয়াই সাংবিধানিক নীতিকে চাপা দেওয়া যায় না, বা ছোট কোনও গোষ্ঠীর বিশ্বাস বা ব্যবহারকে অস্বীকার করা যায় না— মহামান্য বিচারপতিদের এই বাক্যটি বর্তমান ভারতের আকাশে ধ্বনিত হইবে, এমন আশা রহিল। সমকামিতা কেন, আরও অনেক সামাজিক সংঘাত হইতে বাহির হইবার দিশা নিহিত এই একটি বাক্যের মধ্যে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy