নিরবচ্ছিন্ন বিষাদ সরিয়ে হরষিত হওয়ার অবকাশ পাওয়া গেল যেন অনেক দিন পরে। সন্ত্রাসবাদ তার ঘৃণ্য এবং করাল থাবা হেনেছে জম্মু-কাশ্মীরের পুলওয়ামায় সম্প্রতি। মানবতার ওই ঘৃণিত শত্রুদের উপযুক্ত জবাব দেওয়া অত্যন্ত জরুরি। কিন্তু জবাব দেওয়ার সে তাড়না বা সঙ্গত ক্রোধ যখন বিপথগামী হয়ে পড়ে, তখন অনাকাঙ্খিত সঙ্কট ঘনাতে শুরু করে। ঘরোয়া অশান্তি এবং দেশের মানুষকেই ‘দেশদ্রোহী’ বা ‘পাকিস্তানি’ হিসেবে চিহ্নিত করার প্রবণতাটাই হল সেই অনাকাঙ্খিত সঙ্কট। সেই সঙ্কট বিষাদসিন্ধুতে ক্রমশ ডুবিয়ে দিচ্ছিল জাতির বিবেককে যখন, ঠিক তখনই আশার দীপশিখা জ্বলে উঠল। অনেক দিন পরে কোনও উন্মুক্ত পৃথিবীর বাতাস যেন বয়ে এল উঠোনে। শ্বাস নেওয়া গেল উন্মুক্ত বাতাসে।
শুধু আক্রোশ, শুধু বিদ্বেষ, শুধু হিংসা, শুধু আঘাত-প্রত্যাঘাতের খবর শুনতে হচ্ছিল দিনের পর দিন। বলা বাহুল্য সে খবর কখনও অনিন্দ্য আনন্দানুভূতি বয়ে আনে না, বিষাদই বয়ে আনে বরং। সে বিষাদকে গভীরতর করে তুলছিল ঘরোয়া বিদ্বেষ। পাক ভূখণ্ডে ভারতের সামরিক অভিযানের খুঁটিনাটি নিয়ে কোনও প্রশ্ন তুললেই ‘দেশদ্রোহী’ বলে দাগিয়ে দেওয়া হচ্ছিল। যুদ্ধের বিরুদ্ধে সরব হতে চাইলেই ‘দেশবিরোধী’ আখ্যা দেওয়া হচ্ছিল। দেশেরই কোনও জনগোষ্ঠীকে ‘পাকিস্তানি’ হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছিল। সেই অবান্তর, অযৌক্তিক এবং অন্ধ বিদ্বেষের শিকার হচ্ছিলেন কাশ্মীরিরা। কর্মসূত্রে দেশের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা কাশ্মীরিরা আক্রান্ত হচ্ছিলেন বার বার। কখনও বাংলা থেকে, কখনও উত্তরপ্রদেশ থেকে, কখনও দেশের অন্য কোনও প্রান্ত থেকে কাশ্মীরিদের উপরে আক্রমণের খবর আসছিল। সেই বাংলাই আবার মন জুড়িয়ে দিল। বাঙালি হিন্দু পরিবারের মেয়ের বিয়েতে আত্মার আত্মীয় হিসেবে হাজির থাকতে হল কাশ্মীরি মুসলিম বস্ত্র বিক্রেতার পরিবারকে।
হুগলি জেলার উত্তরপাড়ায় বাঙালির বিবাহ বাসরে পরম কাঙ্খিত অতিথি কাশ্মীরি আফাক শাহ এবং তাঁর পরিবার। ‘বোনের’ জন্য আফাকের বহু মূল্য উপহার বা ‘দাদার’ জন্য মিমির পরিবারের আন্তরিক আত্মীয়তার আখ্যান আজকের তারিখে যেন রূপকথার মতো শোনায়। কিন্তু রূপকথা নয়, ভারতের বাস্তবতা এটাই। কাশ্মীর যতটা ভারত, কন্যাকুমারীও ততটাই। কচ্ছ যতটা ভারত, কোহিমাও ততটাই। আক্রোশ বা বিদ্বেষে দ্বিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে কেউ কেউ হয়ত ভুলে যান সে কথা। কিন্তু ভারতের বাস্তবতা তাতে বদলায় না। ভারতীয়ত্বে নিহিত অপার ঔদার্যের অমোঘ আত্মপ্রকাশ ঘটে।