ডোনাল্ড ট্রাম্প। —ফাইল চিত্র
আধুনিক গণতন্ত্রের ইতিহাসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক ইমপিচমেন্টের প্রয়াসটি সম্ভবত মাইলফলক হইয়া থাকিবে। অবশ্যই নেতিবাচক অর্থে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের বিরুদ্ধে এই ইমপিচমেন্ট প্রয়াস যে ব্যর্থ হইল, তাহাই একমাত্র গুরুতর কথা নহে। এই প্রয়াস ব্যর্থ হইবে, তাহা মোটামুটি জানাই ছিল। ডেমোক্র্যাট নেতানেত্রীরাও বিলক্ষণ জানিতেন যে, হাউস অব রিপ্রেজ়েন্টেটিভস-এ প্রস্তাব পাশ করাইলেও রিপাবলিকান-গরিষ্ঠ সেনেটে তাহা পাশ হইবে না। তাহা সত্ত্বেও এই প্রয়াস যে তাঁহারা করিয়াছিলেন, তাহার একটিই কারণ। ইমপিচমেন্ট নামক সাংবিধানিক পদ্ধতিটি যে হেতু অতি ব্যতিক্রমী, দলের সংখ্যার বিচারে বিচার্য নহে, ভাবা হইয়াছিল— দেশের প্রেসিডেন্ট, যিনি বিশ্বের অন্যতম প্রধান গণতান্ত্রিক ফেডারেল রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ শাসক, তাঁহার বিরুদ্ধে গুরুতর ভাবে জাতীয় স্বার্থ বিপন্ন করিবার অভিযোগ উঠিলে, দলমত ইত্যাদি ক্ষুদ্র স্বার্থ অতিক্রম করিয়া বৃহত্তর ও গভীরতর বিবেচনা-সহ জনপ্রতিনিধিরা সেই প্রস্তাবের পক্ষে বা বিপক্ষে ভোট দিবেন। অর্থাৎ দলীয় রাজনীতির ঊর্ধ্বে সাংবিধানিক গণতন্ত্রের যে নৈতিকতা ও নিরপেক্ষতা, তাহার উপর ভরসা করিয়াই ইমপিচমেন্টের মতো প্রক্রিয়ায় অগ্রসর হইয়াছিলেন বিরোধী নেতৃবৃন্দ। এমন একটি ভাবনা অযৌক্তিকও বলা যায় না। ট্রাম্প যে তাঁহার বিরোধী নেতা বিডেনের বিরুদ্ধে অন্য একটি দেশকে তদন্ত করিতে উস্কাইয়া নিজের দেশের সার্বভৌমতা ক্ষুণ্ণ করিয়াছেন, ইহা এখন আর সামান্য অভিযোগমাত্র নহে, তথ্যপ্রমাণসহকারে প্রতিষ্ঠিত সত্য। দ্বিতীয়ত, কেবল এ-হেন গর্হিত কাজই নহে, নিজের বিরুদ্ধে তদন্ত আটকাইবার সমস্ত প্রচেষ্টা ট্রাম্প করিয়াছেন— বলা বাহুল্য, নিজের ক্ষমতার চূড়ান্ত অপব্যবহার করিয়া। অর্থাৎ ব্যক্তিগত ক্ষমতার জন্য তিনি রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা ও রাষ্ট্রীয় সম্পদের বিপুল অপব্যবহার করিয়াছেন। সাংবিধানিক বিধিমতে, ইহা অতীব বড় মাপের অন্যায়। এই পরিস্থিতিতে, ইমপিচমেন্ট প্রস্তাব পাশ না হইবার ঘটনা দেখাইয়া দিল যে— একটি ব্যতিক্রমী জাতীয় দুর্যোগের দিনেও জনপ্রতিনিধিরা দলীয় স্বার্থের, কিংবা ব্যক্তিগত স্বার্থের উপরে উঠিতে পারিলেন না।
ইতিপূর্বে আমেরিকায় তিন বার ইমপিচমেন্ট প্রক্রিয়া ঘটিয়াছে, কিন্তু কোনও বারই প্রেসিডেন্টকে অপসারিত হইতে হয় নাই। এতৎসত্ত্বেও বলিতে হয়, ট্রাম্পের ক্ষেত্রটি অভূতপূর্ব। গোটা পর্ব জুড়িয়া প্রেসিডেন্ট নিতান্ত হাসিঠাট্টায় মাতিয়া থাকিলেন। ইমপিচমেন্টকে তিনি গুরুত্ব দিতেই রাজি নহেন, আচারে ব্যবহারে ক্রমাগত বুঝাইয়া দিলেন। প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট ক্লিন্টনের মতো ক্ষমাপ্রার্থনা তো দূরস্থান, ট্রাম্প বলিলেন, তাঁহার বিরুদ্ধে চক্রান্ত হইয়াছে। সেনেট ভোটের পর হোয়াইট হাউস প্রাঙ্গণে বিজয় মিছিলের আয়োজন করিলেন। তথাকথিত ‘নিরপেক্ষ’ অ্যাটর্নি জেনারেল-ও উৎসবে যোগ দিলেন। বিপরীতে, স্পিকার তথা ডেমোক্র্যাট নেত্রী ন্যান্সি পেলোসি যে ভাবে প্রেসিডেন্টের বক্তৃতার প্রতিলিপি সর্বসমক্ষে ছিঁড়িয়া ফেলিলেন, তাহাকেও দলরাজনীতির দুর্ভাগ্যজনক প্রদর্শন ছাড়া কী বলা যায়। সাংবিধানিক গণতন্ত্রের সর্ববৃহৎ শত্রু যে গণতন্ত্র নিজেই— গণতান্ত্রিক প্রতিনিধি ও শাসকেরা আজ পদে পদে তাহা বুঝাইয়া দিতেছেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy