Advertisement
E-Paper

উনিশ শতকের পাঁচালি ও দাশরথি রায়

সেই সময় কলকাতা ও মফস্সলে পাঁচালির রূপটি জনপ্রিয়তা লাভ করছিল। তরুণ দাশরথি সেখানেই মনোনিবেশ করেন। নিজেই পাঁচালির দলও খুললেন। লিখছেন রথীনকুমার চন্দ সেই সময় কলকাতা ও মফস্সলে পাঁচালির রূপটি জনপ্রিয়তা লাভ করছিল। তরুণ দাশরথি সেখানেই মনোনিবেশ করেন। নিজেই পাঁচালির দলও খুললেন। লিখছেন রথীনকুমার চন্দ

শেষ আপডেট: ৩০ এপ্রিল ২০১৯ ১০:৪৩
বাঁধমুড়া গ্রামে দাশরথি রায়ের জন্মভিটে। এখানে রয়েছে এই ফলকটি (ইনসেট)। ছবি: অসিত বন্দ্যোপাধ্যায়

বাঁধমুড়া গ্রামে দাশরথি রায়ের জন্মভিটে। এখানে রয়েছে এই ফলকটি (ইনসেট)। ছবি: অসিত বন্দ্যোপাধ্যায়

‘রামমোহনের প্রগতিশীল জীবনের অবসান ঘটেছিল (১৮৩৩) তাঁর অভিজ্ঞতার সীমায়। বিদ্যাসাগরের সামাজিক আন্দোলনের তিনি প্রত্যক্ষ সাক্ষী ছিলেন। এই সব কিছুর আলোড়ন তাঁর চেতনায় পাঁচালির গান জাগিয়ে তুলেছিল কথার চটকে, শব্দের ঝঙ্কারে, আসর মাতানো সঙ্গীতের রেশে। উনিশ শতকের মধ্যদিগন্তেও তিনি অষ্টাদশ শতকের কাব্যিক ঐতিহ্যের উত্তরসূরী।’ তাঁর ‘বাংলা সাহিত্যের ইতিকথা’ (দ্বিতীয় পর্যায়) গ্রন্থে উনিশ শতকের পাঁচালিকার দাশরথি রায়ের মূল্যায়ন করতে গিয়ে এমন মন্তব্যই করেছিলেন ভূদেব চৌধুরী। শুধু তিনিই নন, সুকুমার সেন, অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, দীনেশচন্দ্র সেনের মতো প্রায় সব সাহিত্য গবেষকরাই মনে করেন, উনিশ শতকে যে পাঁচালির ধারা বাংলার গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে ছড়িয়ে পড়েছিল তার মূল ভগীরথ ছিলেন বর্ধমান জেলার বাঁধমুড়া (বাঁদমুড়া) গ্রামের সন্তান দাশরথি রায়।

দাশরথি রায়কে নিয়ে প্রথম আলোচনা করেছিলেন ‘সংবাদ প্রভাকর’ পত্রিকার সম্পাদক ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত। পরে তাঁর জীবন ও সাহিত্য সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়েছে হরিপদ চক্রবর্তীর ‘দাশরথি রায় ও তাহার পাঁচালী’, ‘দাশরথি রায়ের পাঁচালী’, নিরঞ্জন চক্রবর্তীর ‘উনবিংশ শতাব্দীর পাঁচালীকার ও বাংলা সাহিত্য’ প্রভৃতি গ্রন্থে। সাহিত্য গবেষকরা মনে করেন, ১৮০৬ সালের (১২১২ বঙ্গাব্দের মাঘ মাসে) অধুনা কাটোয়ার নিকটবর্তী বাঁদমুড়া বা বাঁধমুড়া গ্রামে তাঁর জন্ম। বাবা দেবীপ্রসাদ ও মা শ্রীমতী দেবী। দাশরথির শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে নানা মত রয়েছে। কারও মতে তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার দৌড় খুব বেশি ছিল না। সংস্কৃত ভাষায় লেখা পুরাণ, দর্শন প্রভৃতি গ্রন্থ পাঠে তিনি বিশেষ পারদর্শী ছিলেন না। লোকমুখে প্রচলিত কাহিনি থেকে তিনি নাকি তাঁর গল্পের বা পাঁচালির উপাদান সংগ্রহ করেছেন। কিন্তু এ প্রসঙ্গে অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় মনে করেন, মূল সংস্কৃত না জানলে তাঁর পক্ষে খুঁটিনাটি পৌরাণিক তথ্য পাঁচালির কাহিনিতে পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে লিপিবদ্ধ করা সম্ভব হত না।

পীলাগ্রামের কাছের বহরা গ্রামের হরকিশোর ভট্টাচার্যের কাছে দাশরথি রায়ের ইংরেজি শেখার হাতেখড়ি। ইংরেজি জানার সুবাদে তিনি কিছু দিন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির রেশমের কুঠিতে চাকরিও করেছিলেন। কিন্তু শৈশব থেকে ছড়া, গান ইত্যাদির চর্চার কারণে সে পেশায় স্থিত হতে পারলেন না। তাঁর মামার বাড়ি পীলাগ্রামে থাকালীন তিনি আকাবাঈ বা অকাবাঈ (অক্ষয়া বাইতিনী)-এর প্রেমে পড়েন। পরে অকাবাঈ কবিগানের দল তৈরি করলে দাশরথি সেই দলে যোগ দেন। কিন্তু সে কালের কবিগানের রীতি তাঁকে সন্তুষ্ট করতে পারেনি। কবিগানের সময় ব্যক্তিগত আক্রমণ, পারস্পরিক কুৎসা প্রভৃতি দেখে তিনি হতোদ্যম হয়ে পড়েন এবং দলত্যাগ করেন। সেই সময় কলকাতা ও মফস্সলে পাঁচালির রূপটি জনপ্রিয়তা লাভ করছিল। তরুণ দাশরথি সেখানেই মনোনিবেশ করেন। অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের তথ্য অনুসারে, তিনি ১৮৩৬ সালে তিরিশ বছর বসে নিজের পাঁচালির দল খুললেন। বছর দেড়েকের মধ্যে পাঁচালিকার হিসেবে খ্যাতিলাভ করেন। ১৮৩৯ সালে নবদ্বীপে তিনি আমন্ত্রিত হয়ে পাঁচালি পরিবেশন করেন। সেকালের বৈষ্ণব তীর্থপতিরাও তাঁর গানে মুগ্ধ হয়েছিলেন। জীবনের বাকি পর্বে তিনি নিরবচ্ছিন্ন ভাবে পাঁচালির চর্চা করে গিয়েছেন।

অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় জানাচ্ছেন, দাশরথি রায়ের জীবৎকালে তাঁর পালাগুলি পাঁচটি খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছিল। তাঁর মৃত্যুর পরে আরও পাঁচটি খণ্ড প্রকাশিত হয়। এই দশটি খণ্ডে মোট চৌষট্টি (মতান্তরে পঁয়ষট্টিটি) পালা রয়েছে। পালাগুলিকে বিষয় অনুসারে সাত ভাগে বিভক্ত করা যায়— কৃষ্ণলীলা, রামলীলা, হর-পার্বতীলীলা, চণ্ডীলীলা, মহাভারতের বিভিন্ন পৌরাণিক লীলা, মঙ্গলকাব্যের পালা ও আধুনিক পালা। এর মধ্যে কৃষ্ণলীলা বিষয়ক পালার মধ্যে রয়েছে শ্রীকৃষ্ণের জন্মাষ্টমী, নন্দোৎসব, শ্রীকৃষ্ণের গোষ্ঠলীলা ও কালীয়দমন, , শ্রীরাধিকার দর্পচূর্ণ, গোপীদিগের বস্ত্রহরণ, অক্রূর সংবাদ-সহ মোট একুশটি পর্যায়। ‘শ্রীরামচন্দ্রের বিবাহ’-সহ বিভিন্ন পালা রামলীলার অন্তর্ভুক্ত। ‘দক্ষযজ্ঞ’, ‘শিববিবাহ’, ‘ভগবতী ও গঙ্গার কোন্দল’ প্রভৃতি পালা হরগৌরীলীলার অন্তর্গত। মহাভারতে দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ, দুর্বাসার আহার প্রভৃতি বিষয় নিয়েও তিনি পালা লিখেছেন। সে কালের শাক্ত বৈষ্ণবের দ্বন্দ্ব, বিধবা বিবাহ, কর্তাভজা সম্প্রদায়ের উপাসনা পদ্ধতি, প্রভৃতি বিষয় নিয়েও তিনি পালা লিখেছেন। অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে, ‘নবীনচাঁদ ও সোনামণি, নলিনী-ভ্রমরের বিরহ, ভেক-ভৃঙ্গদ্বন্দ্ব— এগুলিতে সামাজিক উপাদান যৎকিঞ্চিৎ থাকলেও এই রঙ্গপালাগুলি লীলাচ্ছলে রচিত হয়েছে। দাশরথি রঙ্গকৌতুক সৃষ্টির জন্য এবং তারই সঙ্গে মানবেতর প্রাণীর রূপকের সাহায্যে চাবুক চালিয়েছেন। এর পিছনে স্পষ্ট ভাবে লোকশিক্ষা দেওয়ার ইচ্ছা ছিল, তারও চেয়ে ছিল শ্রোতাদের স্থূল অনুভূতির কেন্দ্রে মোটাহাতের সুড়সুড়ি দেওয়া।’

পুরাণ থেকে কাহিনি নিলেও দাশরথি সে কালের যুগবৈশিষ্ট্য অর্থাৎ ‘লোকরঞ্জন’-কে কোনওভাবেই উপেক্ষা করেননি। ফলে তাঁর পালায় এক দিকে যেমন সংস্কৃত শব্দের ঝঙ্কার শোনা গিয়েছে, অন্য দিকে তেমনই দেখা গিয়েছে প্রচলিত লোকশব্দের সার্থক ব্যবহারে অনুপ্রাস ও যমক সৃষ্টির প্রয়াস। লোকরঞ্জনের জন্য তিনি তাঁর পালায় এমন কিছু প্রসঙ্গের অবতারণা করেছেন, যাকে আজকের যুগে ‘অশালীন’ বলে মনে হতে পারে কিন্তু সে কালের জনরুচিকে তৃপ্ত করতে অন্য কোনও পথ অবলম্বন করার উপায় তাঁর সামনে ছিল না।

সব শেষে বলতে হয় দাশরথির ঈশ্বর ও আধ্যাত্মিকভাবের সঙ্গীতের কথা। তাঁর লেখা বেশ কয়েকটি ঈশ্বরসঙ্গীত আজও শ্রোতাদের কাছে সমাদৃত। তাঁর মধ্যে জনরুচি ও সাহিত্যকে মেলানোর যে ক্ষমতা ছিল তা সে কালের বাংলা সাহিত্যে বিশিষ্ট স্থান করে নিয়েছিল। তাই দাশরথি প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের উদ্ধৃতিটিই বড় বেশি প্রাসঙ্গিক মনে হয়— ‘দাশুরায়ের পাঁচালি দাশরথির ঠিক একলার নহে;— যে-সমাজ সেই পাঁচালি শুনিতেছে, তাহার সঙ্গে যোগে এই পাঁচালি রচিত। এইজন্য এই পাঁচালিতে কেবল দাশরথির একলার মনের কথা পাওয়া যায় না— ইহাতে একটি বিশেষ কালের বিশেষ মণ্ডলীর অনুরাগ-বিরাগ, শ্রদ্ধা-বিশ্বাস-রুচি আপনি প্রকাশ পাইতেছে।’( সাহিত্যসৃষ্টি, সাহিত্য)

তথ্যঋণ: ১) বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত (চতুর্থ খণ্ড): অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, ২) বাংলার সাহিত্য-ইতিহাস: সুকুমার সেন, ৩) বাংলা সাহিত্যের ইতিকথা, (দ্বিতীয় পর্যায়): ভূদেব চৌধুরী, ৪) বঙ্গভাষা ও সাহিত্য: দীনেশচন্দ্র সেন

বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাকর্মী

Dasarathi Roy দাশরথি রায়
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy