Advertisement
E-Paper

বাংলার গণতন্ত্রের মুখটা ঠিক হাফিজুলের মতো

হাফিজুল মোল্লার ক্ষতবিক্ষত মুখমণ্ডল, রক্তাক্ত শরীর, অবসন্ন অস্তিত্বের ছবি ভেসে উঠছে বার বার। পঞ্চায়েত ভোটের ঠিক আগে হাফিজুল যেন বাংলার গণতন্ত্রের মুখ হয়ে উঠলেন।

অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১২ মে ২০১৮ ০০:৪৩
জবরদখলের শিকার হয়ে পড়লেন হাফিজুল মোল্লা। ভাঙড়ের মাটি রক্তে ভিজে গেল। —নিজস্ব চিত্র।

জবরদখলের শিকার হয়ে পড়লেন হাফিজুল মোল্লা। ভাঙড়ের মাটি রক্তে ভিজে গেল। —নিজস্ব চিত্র।

দশচক্রে অমৃত সম্ভবত গরল হয়ে ওঠে। বাংলার মাটিতে অহরহ তার প্রমাণ মিলছে গত প্রায় এক মাস ধরে। নাগরিক সমাজকে মুক্ত-স্বাধীন-অবারিত পরিসর দেওয়ার জন্য যে পঞ্চায়েতের ভাবনা, সেই পঞ্চায়েত কালক্রমে বদলে গেল বিভীষিকায়। মুক্তি বা স্বাধীনতার হাতিয়ার নয়, নির্লজ্জ জবরদখলের নামান্তর হয়ে দাঁড়াল পঞ্চায়েত যেন। আর সেই জবরদখলের শিকার হয়ে পড়লেন হাফিজুল মোল্লা। ভাঙড়ের মাটি রক্তে ভিজে গেল। পঞ্চায়েত ফের রক্তস্নান করল।

রাজনীতির রথী-মহারথীদের জন্য পঞ্চায়েত নির্বাচন নয়। শুধু রাজনীতির কথাই বা কেন বলব, সামাজিক রথী-মহারথীদের জন্যও খুব একটা জরুরি বোধ হয় নয় পঞ্চায়েতের মতো স্থানীয় স্তরের ব্যবস্থাপনা সংস্থা। রামা কৈবর্ত বা রহিম আলির মতো নিতান্ত সাধারণ যে জনগোষ্ঠী আমাদের জনসংখ্যার সুবৃহৎ অংশ জুড়ে রয়েছে, পঞ্চায়েতের মতো সংস্থার উপর দৈনন্দিন নির্ভরতা সেই জনগোষ্ঠীরই। কিন্তু তা বলে কি এই নির্বাচনকে ‘অবহেলা’ করতে পারেন মহারথী রাজনীতিকরা! একেবারেই পারেন না। জনসংখ্যার সিংহভাগ‌ তো এই পঞ্চায়েত-নির্ভরদের নিয়েই। পঞ্চায়েতগুলো নিঃশেষে দখল করতে না পারলে এই সিংহভাগের উপরে ছড়ি ঘোরানোর সুযোগ কোথায়? ছড়ি ঘোরানোর সুযোগ না থাকলে এই জনগোষ্ঠীর ভোটের উপরে নিজেদের নিরঙ্কুশ অধিকার বা কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করার অবকাশ কোথায়? আর সে অবকাশ না থাকলে বছরের পর বছর মহারথে আসীন থাকার সুযোগ কোথায়?

অতএব, ঝাঁপিয়ে পড়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে দুষ্কৃতী বাহিনীকে। ‘অকিঞ্চিৎকর’ দু’একটা হাফিজুল মোল্লার প্রাণ নিয়ে নেওয়ার নীরব ছাড়পত্র দেওয়া রয়েছে আরাবুল ইসলামের মতো ‘তাজা নেতা’ বা ‘দামাল ছেলেকে’। কী কী দেখে নিষ্ক্রিয় থাকতে হবে এবং শাসকের বিপদ দেখলে কী ভাবে সক্রিয় হতে হবে, তা স্পষ্ট করে শেখানো রয়েছে পুলিশ-প্রশাসনকে। অতএব পঞ্চায়েত দখল অভিযান সম্পূর্ণ মিটে না যাওয়া পর্যন্ত এ রকম দৃশ্যের সাক্ষী হতেই হবে।

সম্পাদক অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা আপনার ইনবক্সে পেতে চান? সাবস্ক্রাইব করতে ক্লিক করুন

মৃত্যু তার বীভৎস মুখচ্ছবিটা দেখিয়ে গেল আরও এক বার। দক্ষিণ ২৪ পরগনার ভাঙড় অঞ্চলের নতুনহাটে দুঃস্বপ্নের আবাহন হল। জমি, জীবিকা, বাস্তুতন্ত্র ও পরিবেশ রক্ষা কমিটির ডাকে মিছিল বেরিয়েছিল ভাঙড়ে। কমিটির তরফ থেকে নির্দল প্রার্থী হিসেবে পঞ্চায়েত ভোটে লড়ছেন যাঁরা, তাঁদের সমর্থনেই বেরিয়েছিল মিছিল। ঘিরে ধরে গুলি চালানোর অভিযোগ উঠেছে তৃণমূলের তাজা বা দামাল নেতা আরাবুল ইসলামের বিরুদ্ধে। মুখ্যমন্ত্রী আরাবুলকে গ্রেফতার করতে বলেছেন। আরাবুল গ্রেফতারও হয়েছেন। কিন্তু যে ভাবে হামলা হয়েছে, তাতে শুধু এক জন বা দু’জন নয়, প্রায় এক ডজনের গ্রেফতারই হওয়ার কথা। বলাই বাহুল্য তা হয়নি। স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন উঠে গিয়েছে, প্রশাসন কি আদৌ এই দুষ্কৃতীদের বিরুদ্ধে কোনও পদক্ষেপ করতে চাইছে? নাকি আরাবুলকে অল্প সময়ের জন্য এলাকা থেকে সরিয়ে নিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে চাইছে?

আরও পড়ুন
ভাঙড়ে গুলিতে হত ১, মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে গ্রেফতার আরাবুল

এই জল্পনা বাড়ছে, কারণ রাজনীতিকদের উপরে বিন্দুমাত্র ভরসাও আর অবশিষ্ট থাকছে না সাধারণ নাগরিকের। সব কিছুই রাজনীতির কোনও ছকে আগাম কষে রাখা রয়েছে— জনমানসে এমন এক ধারণা জন্মাচ্ছে। সেই ছক ভেস্তে দেওয়ার লক্ষ্যেই জনসাধারণ পথে নামছেন, মৃতদেহ রাস্তায় ফেলে রেখে বিক্ষোভ করছেন। অরাজকতার জবাব অরাজকতা দিয়েই দেওয়ার চেষ্টা করছেন।

হাফিজুল মোল্লার ক্ষতবিক্ষত মুখমণ্ডল, রক্তাক্ত শরীর, অবসন্ন অস্তিত্বের ছবি ভেসে উঠছে বার বার। পঞ্চায়েত ভোটের ঠিক আগে হাফিজুল যেন বাংলার গণতন্ত্রের মুখ হয়ে উঠলেন। সেই গণতন্ত্র, যার মাথা ভেঙে দেওয়া হয়েছে, মুখমণ্ডল ক্ষতবিক্ষত, শরীর অবসন্ন। সেই বীভৎসতার সাক্ষী হয়েই ভোটে যাচ্ছে বাংলা। জবাবের অপেক্ষায় সময়।

Newsletter Anjan Bandyopadhyay অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় Bhangar Democracy
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy