Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪

মোদীপিডিয়া

কেন্দ্রীয় সরকার স্পষ্টতই নব্যধ্রুপদী পথে হাঁটিতে উদ্‌গ্রীব। কিন্তু, তাহার জন্য অর্থনীতির মানচিত্রটি বুঝিতে হয়, পথের ঢাল চিনিতে হয়।

ছবি: পিটিআই।

ছবি: পিটিআই।

শেষ আপডেট: ০৬ জুলাই ২০১৯ ০০:০১
Share: Save:

অর্থনীতির আয়তন যদি পাঁচ বৎসরে ১.৮ লক্ষ কোটি ডলার হইতে বাড়িয়া ২.৭ লক্ষ কোটি ডলারে পৌঁছায়, তবে অপরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আরও পাঁচ বৎসরে তাহা কত হইবে? পাটিগণিত জানিলে উত্তর দেওয়া কঠিন নহে— চার লক্ষ কোটি ডলারের সামান্য বেশি। এ দিকে রব উঠিয়াছে, ২০২৪ সালের মধ্যে ভারত পাঁচ লক্ষ কোটি ডলারের অর্থনীতি হইয়া উঠিবে। অর্থনৈতিক সমীক্ষাও বলিয়াছে, নির্মলা সীতারামনও বলিলেন। এই অতিরিক্ত এক লক্ষ কোটি টাকার কী ব্যবস্থা হইবে— আয়বৃদ্ধির যে সোনার কাঠি গত পাঁচ বৎসরে খুঁজিয়া পাওয়া যায় নাই, নর্থ ব্লকের অলিন্দে তাহা হঠাৎ পড়িয়া পাওয়া গেল কি না— বাজেট বক্তৃতায় তাহার কোনও উত্তর নাই। বক্তৃতাটি নরেন্দ্র মোদীর ভাষণের ন্যায়— অনেক কথা বলিয়াও কোনও কথা না বলিবার অনুশীলন। যেমন, আগামী পাঁচ বৎসরে পরিকাঠামো খাতে একশো লক্ষ কোটি টাকা খরচের প্রতিশ্রুতি। যেমন, আবাস যোজনায় ঢালাও নির্মাণের প্রতিশ্রুতি। টাকা জোগাইবেন কোন গৌরী সেন? অবশ্য, অর্থমন্ত্রী তাঁহার ভাষণে জিডিপির অঙ্কটিরও উল্লেখ করেন নাই; বৃদ্ধির হার কোথায় দাঁড়াইল, বলেন নাই। বরং, একাধিক অর্ধসত্য বলিলেন— যেমন, ব্যাঙ্কের অনাদায়ী ঋণের পরিমাণ কমিবার কথা বলিলেও মোদীর জমানায় তাহার বাড়বাড়ন্তের তুলনায় হ্রাস যে নগণ্য, তাহা বলিলেন না; প্রত্যক্ষ কর আদায়ের পরিমাণ বৃদ্ধির কথা বলিলেও জিএসটির বিপুল ঘাটতি অনুল্লিখিত থাকিল। ভাষণ-শেষে আলগোছে রাজকোষ ঘাটতির অনুপাতটি জানাইলেন। ইহাকে বাজেট বক্তৃতা বলিলে সত্যের অপলাপ হয়।

কেন্দ্রীয় সরকার স্পষ্টতই নব্যধ্রুপদী পথে হাঁটিতে উদ্‌গ্রীব। কিন্তু, তাহার জন্য অর্থনীতির মানচিত্রটি বুঝিতে হয়, পথের ঢাল চিনিতে হয়। বাজার অর্থনীতি মানে শুধু হাতে থাকা রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা বেচিয়া কিছু টাকার সংস্থান করিয়া ঘাটতি পূরণ করা নহে। বিলগ্নিকরণের যেমন নির্দিষ্ট নীতি থাকা প্রয়োজন, তেমনই বিদেশি লগ্নির জন্য দরজা খুলিবার সিদ্ধান্তটিও খামখেয়ালি হইলে চলে না। অর্থনৈতিক সমীক্ষা এবং বাজেট ভাষণ বলিতেছে, বিনিয়োগের জন্য সরকার বহুলাংশে বিদেশের দিকে চাহিয়া আছে। দেশের টাকাই সিঙ্গাপুর বা মরিশাসের ন্যায় করছাড়ের স্বর্গ হইতে ঘুরিয়া বিদেশি বিনিয়োগ হিসাবে ঢুকিবে কি না, অথবা প্রকৃত বিদেশি লগ্নির টাকাতেও নূতন বিনিয়োগ হইবে; না কি তাহা মালিকানা হস্তান্তরের পিছনে খরচ হইবে— এই কথাগুলি স্পষ্ট না হইলে এই বিদেশি লগ্নিনির্ভরতা বিপজ্জনক হইতে পারে। তাহা উদার অর্থনীতি নহে, আত্মঘাতী অর্থনীতি।

এই বাজেটের অভিজ্ঞান তাহার স্থূলতা। তাহার আরও একটি উদাহরণ অন্ত্যোদয়ের উল্লেখ। ২০১৯ সাল গাঁধীর সার্ধশতবর্ষ বটে, কিন্তু তাহার জন্য স্বচ্ছ ভারত আর গাঁধীপিডিয়াই কি যথেষ্ট ছিল না? সরকারের প্রতিটি সিদ্ধান্তেরই কেন্দ্রে থাকে অন্ত্যোদয়ের দর্শন— এই বিচিত্র দাবিটির প্রয়োজন ছিল কি? প্রথমত, যে সরকার সচেতন ভাবে নব্যধ্রুপদী অর্থনীতির পথে হাঁটিতে চাহে, তাহার কেন্দ্রে অন্ত্যোদয়ের ধারণা থাকিতে পারে না। থাকিবার প্রয়োজনও নাই। দ্বিতীয়ত, সামাজিক ক্ষেত্র থেকে কার্যত হাত গুটাইয়া লইয়া, ট্রিক্‌ল ডাউনের হাতে উন্নয়নের ভার ছাড়িয়া দিয়া, সামাজিক সাম্যের ধারণাটিকে বর্জন করিবার পর অন্ত্যোদয়ের কথা বলিলে গাঁধীর সম্মানবৃদ্ধি হয় না। নির্মলা জানাইয়াছেন, অতঃপর নাগরিকের অধিকারের পরিবর্তে রাষ্ট্রের প্রতি তাঁহাদের দায়িত্বই অর্থনীতির চালিকাশক্তি হইবে। অস্যার্থ, এত বৎসরে সাম্যের অভিমুখে যাত্রার যেটুকু রসদ অর্জন করা গিয়াছিল, এই বার রাষ্ট্র তাহা কাড়িয়া লইতেই পারে। এত দিন জানা ছিল, ইহাকেই অন্ত্যোদয়ের দর্শন বলিতে পারে কেবলমাত্র নরেন্দ্র মোদীর ভাষণ। নির্মলা ধারণাটি পাল্টাইয়া দিলেন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Union Budget 2019 Narendra Modi
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE