আবার বছর কুড়ি পরে তার সাথে দেখা হয় যদি!’— জীবনানন্দ দাশ ধরতে চেয়েছিলেন সময়কে। যে জীবন বহমান, তার নামই সময়। সে চলে যায়, পিছু ফিরে চায় না। আমাদের শরীরে, অন্তরে, জীবনচক্রে তার চলে যাওয়ার দাগ থেকে যায়। তাকে বলে বয়স। এক এক বার মানুষের জীবনে সময় স্থির হয় মুহূর্তের জন্য। থেমে যায় বিশ্ব চরাচর। তা-ই মৃত্যু। এক লহমায় সে ব্যক্তিসাপেক্ষ। কিন্তু যা ব্যক্তিকেন্দ্রিক, তা তো কখনওই সার্বিক নয়। সময়ের চরিত্র বহমানতার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। তাই মৃত্যু স্থানিক বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন। তার সঙ্গে বৈশ্বিক প্রবণতার মেলবন্ধন ঘটাচ্ছে আজ অতিমারি। অনেকে একসঙ্গে অসুস্থ হয়ে পড়ছেন বা কেউ কেউ মারা যাচ্ছেন, এই বাস্তবতার শিকার যেমন কোনও কোনও মানুষ, তেমনই তার অভিঘাত এসে পড়ছে অন্যদের জীবনের স্বাভাবিক বহমানতার উপর।
সংক্রমিত মানুষ, আক্রান্ত সময়। তাকে বলা হচ্ছে: ‘থেমে থাক’। যার যা চলে যাচ্ছে, সে তো যাচ্ছেই। তবু হয়তো ‘ব্যস্ততা নাইকো আর’। সময় থেমে নেই জেনেও ব্যস্ততা কমেছে। চলুক এ ভাবেই কিছু দিন, তার পর না হয় দেখা যাবে। কিন্তু সব পরিসর সমান নয়। ফিরে ফিরে ধাক্কা মারছে পুরনো ভাবনাগুলো। অর্থনৈতিক নিরাপত্তা আর চিকিৎসা ব্যবস্থার সম-মান কী ভাবে তৈরি করা যাবে? সুস্থতা না কি স্বাভাবিকতা, কোনটা বেশি জরুরি?
এমন তো হতে পারে, ‘কুড়ি বছরের পরে তখন তোমারে নাই মনে!’ এই যে আমাকে পাল্টে দেওয়া হল— যে ভাবে আমি চলতাম-ফিরতাম-হাত মেলাতাম সবটাই বদলে দিতে গিয়ে যদি স্বাভাবিক আমিটাই হারিয়ে যায়? যা কিছু এই সে দিনও স্বাভাবিক ছিল, তাই তো আজ ঘোরতর অপরাধ। অপরিচিত হোক না কেউ, তার পাশে বসা যাবে না? প্রিয়জনের সঙ্গে কথা বলতে বলতে খেয়াল রাখতে হবে, কত ফিট শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখলাম? আনন্দে বন্ধুর পিঠে চাপড় অথবা দুঃখে একটু হাতটা চেপে ধরাও যাবে না? সম্পর্কগুলো সব স্যানিটাইজ় করতে হবে! অনেকে বলছেন, অতিমারি ফুরোলেও আমাদের পুরোদমে পুরনো অভ্যাসে ফেরা যাবে না। নিয়ম মেনেই এখন অনেক দিন চলতে হবে। তবে যদি ভুলে যাই পুরনো অভ্যাস? সুখ-দুঃখ দুই বেলা ভাগ করে নেওয়ার প্রকরণগুলি? সে কি মর্মান্তিক হবে না? শারীরিক দূরত্ব তখন সত্যিই সামাজিক দূরত্ব হবে। কোনও কঠোর ব্যবস্থার দাস তো নয় মানুষের সমাজ— সে তো মেলামেশার ফসল। আঘাত আজ সেখানেই। মনুষ্য জীবনের মূল সত্তাই আজ বিপন্ন। অনলাইন তো আমরা অনেক দিনই হয়েছি, তাতে আমাদের একাকিত্ব কাটছিল কি?
‘সোনালি-সোনালি চিল— শিশির শিকার ক’রে নিয়ে গেছে তারে—’ আশা তো ফুরোয় না। হোক না বছর কুড়ি পরে, হোক সে ঘন কুয়াশায়, তার সঙ্গে দেখা হয় যদি? পুরনো যা কিছু তাকে বিসর্জন দিতে হবেই? নতুন করে বাঁচতে শিখতে হবে? কে শেখাবে সেই বেঁচে থাকার মন্ত্র? রাষ্ট্র, রাজনৈতিক দল, গণমাধ্যম? না কি নয়া স্বাভাবিকতা? সময়ের ছাপ থাকবে। কুড়ি-কুড়ি বছর না হোক অনেকগুলো মাস পেরিয়ে এক দিন জীবন তার পুরনো ছন্দে ফিরতে চাইবে। আমরা প্রস্তুত থাকব না? নিজেদের অভ্যাস পাল্টে যেতে পারে। সময় তার বিপন্নতার স্তরও হয়তো পেরিয়ে যাবে। তবু যা যা পড়ে থাকবে তাকে আঁকড়েই বলতে পারব তো, ‘বন্ধু চল’?
শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কি শুধুমাত্র পুঁথিগত বিদ্যা আর প্রতি দিনের নিয়মানুবর্তিতার সাধনক্ষেত্র? সেখানে তো প্রাতিষ্ঠানিকতার ঊর্ধ্বেও ডানা মেলার অবকাশ থাকে। বন্ধুদের সঙ্গে নিত্য দেখা হওয়া, আসা যাওয়ার পথে খোলামেলা আড্ডা-তর্ক— এ সব কি অমূল্য সম্পদ নয়? শিক্ষক, পড়ুয়া উভয়েই সেখানে এক সামাজিক পরিসর রচনা করেন বলে জানা ছিল। উভয়ের প্রতি দিন দেখা হওয়া তাই এত জরুরি ছিল। অনলাইন কখনওই তার বিকল্প হতে পারে না, পরিপূরক হতে পারে মাত্র। এ দিকে আজ ইন্টারনেট যে ‘তাসের দেশ’ তৈরি করছে, সেখানে সবার প্রবেশাধিকার পর্যন্ত নেই। কৃত্রিমতার নিপুণ অভিঘাত এসে পড়ছে পড়ুয়াদের জীবনে। বিশুদ্ধ যান্ত্রিকতায় এই মুহূর্তে আক্রান্ত শিক্ষাক্ষেত্র। আপাতত কিছু করার নেই, মেনে নেওয়া ছাড়া।
এই ভাবে দেখাটাও আসলে নিজের সঙ্গে কথা বলা। এখন সেটাও নিভৃতে সারতে হয়। আমরা যারা অন্য রকম জীবনে অনেক কাল কাটিয়ে তার পর সেই উপাদানগুলিকে সাময়িক পরিহার করতে গিয়ে হাঁপিয়ে উঠছি, তারা এক রকম ভাবছি বটে। নতুন প্রজন্ম হয়তো যে পরিবর্তন ঘটল তাকেই সে স্বাভাবিক ভাবছে, আপন করে নিতে পারছে। তাদের চোখে এই দীর্ঘ স্মৃতির ছায়া পড়বে না, তারা সহজেই হাঁপিয়ে উঠবে না। সামনের বিস্তীর্ণ জীবনে তারা ‘সাবধানতা’ মেনে চলবে, আমাদের মেনে চলতে অনুরোধ করবে। চোখের সামনে তারা দেখছে, দেশের গ্রাম আর শহর কেমন পৃথক হয়ে গেল। পায়ে হেঁটে হেঁটেই কত মানুষ হারিয়ে গেলেন। আবার দূর থেকে কাজে আসতেন যে গৃহ-সহায়িকারা, তাঁরা সংসার বাঁচাতে কাজের বাড়ির সামনে কোথাও থাকার সন্ধানে ব্যাপৃত। আমরা তো আর রোজকার যাতায়াত মেনে নিতে পারি না! সংক্রমণ ঠেকানোই এখন মূল কাজ। স্যানিটাইজ়ার চরণামৃত।
নতুন প্রজন্ম যে অবস্থাটা দেখছে তা হয়তো এখনকার জন্য প্রয়োজনীয়, কিন্তু তা যে স্থায়ী কিছু নয়, সেটাও বুঝতে হবে। এই পর্বান্তরে যা কিছু অন্যায় হল, তাকে ঠিক ভাবে অনুধাবন না করতে পারলে আমাদের ভবিষ্যৎ কোন বোধের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠবে? এক দিন চোখের পাতা নামার মতো চিলের ডানাও স্তব্ধ হবে। তখনও ঘোর কুয়াশায় যদি দেখা হয়, চিনতে পারব তো?
রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, বঙ্গবাসী কলেজ
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy