Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

জেলার নাট্যচর্চা, শখের থেকে গ্রুপ থিয়েটার

বীরভূমে থিয়েটারের শুরু হেতমপুরের রাজপরিবার থেকে। কলকাতার মঞ্চ-থিয়েটার প্রভাবিত করেছিল তখন জেলার বিভিন্ন এলাকার জমিদারদের। সেই গ্রুপ থিয়েটার আজও চলছে জেলার গ্রাম শহরে। পঞ্চাশ, চল্লিশ, ত্রিশের চৌকাঠ পেরিয়েও বেশ কিছু দল থিয়েটার করছে। লিখছেন বিজয়কুমার দাস।১৯৪৮ সালে বহুরূপী নাট্যদল প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গে গ্রুপ থিয়েটারের যাত্রা শুরু।

সিউড়ির রবীন্দ্র সদন মঞ্চে নাটক। নিজস্ব চিত্র

সিউড়ির রবীন্দ্র সদন মঞ্চে নাটক। নিজস্ব চিত্র

শেষ আপডেট: ১১ ডিসেম্বর ২০১৮ ০১:২৪
Share: Save:

বীরভূমের নাট্যচর্চার শুরু ‘শখের থিয়েটার’ থেকে। হেরাসিম লেবেডফ বাংলা থিয়েটার মঞ্চে আনার পরে বাংলা থিয়েটার লালিত হয়েছে অনেক সময় বাবু ও জমিদার শ্রেণির পৃষ্ঠপোষকতায়। কলকাতায় বিভিন্ন ধনাঢ্য নাট্যপ্রেমী মানুষের উদ্যোগে গড়ে উঠেছিল নাট্যমঞ্চ। বিভিন্ন জেলাতেও শখের থিয়েটারের সেই প্রবণতা ছড়িয়ে পড়ে। বীরভূমও তার বাইরে নয়। ১৯৪৮ সালে বহুরূপী নাট্যদল প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গে গ্রুপ থিয়েটারের যাত্রা শুরু। কিন্তু, তার প্রায় ৬৭ বছর আগে হেতমপুরে প্রতিষ্ঠা হয়েছিল ‘লয়্যাল থিয়েটার’ (মতান্তরে রয়্যাল থিয়েটার) নামে নাট্যদলের। পিছনের ইতিহাস খুঁজলে দেখা যাবে, কলকাতার থিয়েটারের প্রভাবে প্রভাবিত হয়ে বিভিন্ন জেলার জমিদার শ্রেণির হাত ধরে শখের থিয়েটার শুরু হয়েছিল। নানা উৎসবে জমিদারবাবুরাও মুখে রং মেখে মঞ্চে থিয়েটার করতে নামতেন।

অবশ্য তার আগে জেলার গ্রাম ও শহরে ছিল যাত্রাগানের প্রভাব। সাধারণ মানুষেরও তুমুল আগ্রহ ছিল যাত্রাপালার প্রতি। তখন মূলত পুরাণ আশ্রিত যাত্রাপালা অভিনীত হত। পরে স্বাধীনতা পূর্বকালে ঐতিহাসিক যাত্রা প্রাধান্য বিস্তার করে। সুখের কথা এই যে, বাংলার প্রাচীন নাট্য পরিচালক শিশুরাম অধিকারী বীরভূমেরই। তিনি ছিলেন অজয় নদীর তীরবর্তী কেন্দুলির অধিবাসী। সেটা ষোড়োশ শতকের কথা। তখন অবশ্য ‘থিয়েটার’ শব্দটি তেমন প্রচলিত ছিল না সাধারণ মানুষের কাছে। যতদূর জানা যায়, দেবদেবীর কাহিনিকে লোকনাট্যের আঙ্গিকে পরিবেশন করা হত শিশুরামের নাট্যধারায়।

বীরভূমে থিয়েটারের শুরু হেতমপুরের রাজপরিবার থেকে। কলকাতার মঞ্চ-থিয়েটার প্রভাবিত করেছিল তখন জেলার বিভিন্ন এলাকার জমিদারদের। বীরভূমে হেতমপুর, লাভপুর, সুরুল, কুণ্ডলা, কীর্ণাহারের জমিদার পরিবারগুলি যাত্রা ও থিয়েটারচর্চায় মেতে উঠেছিল। হেতমপুর তখন জেলার উল্লেখযোগ্য গঞ্জ। এখানকার চক্রবর্তী পরিবার সাহিত্য-সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষকতা করেছিলেন। এই পরিবারের রামরঞ্জন, মহিমারঞ্জন চক্রবর্তী ছিলেন সাহিত্য-সংস্কৃতির উদার পৃষ্ঠপোষক। বিশেষত মহিমারঞ্জন ছিলেন থিয়েটারপ্রেমী। সেটা ঊনবিংশ শতকের আশির দশক। ১৮৮০ সালে মহিমারঞ্জন হেতমপুরে প্রতিষ্ঠা করলেন লয়্যাল থিয়েটার। কলকাতার রঙ্গমঞ্চের প্রথিতযশা নটদের সঙ্গে মহিমারঞ্জনের ছিল নিবিড় যোগাযোগ। সেই সূত্রে হেতমপুরে যাতায়াত ছিল তৎকালীন কলকাতার বিশিষ্ট অভিনেতাদের। সে সময় লয়্যাল থিয়েটারের প্রযোজনায় হেতমপুরে শর্মিষ্ঠা, সিরাজদ্দৌলা, টিপু সুলতান নাটকের অভিনয় হয়েছে। শুধু তাই নয়, হেতমপুরে নির্মিত হয়েছিল কলকাতার রংমহল থিয়েটারের অনুকরণে ঘূর্ণায়মান মঞ্চ।

অর্থাৎ বীরভূমে মঞ্চের ইতিহাস শুরু ঘূর্ণায়মান মঞ্চের মাধ্যমে। শোনা যায়, সতু সেনের তত্ত্বাবধানে হেতমপুরে এই মঞ্চ তৈরি হয়েছিল থিয়েটারের জন্য। ‘অ্যামেচার ড্রামাটিক ক্লাব’ নামে একটি নাটকের দলও গড়ে উঠেছিল হেতমপুরে।

পরবর্তী কালে সেই শখের থিয়েটারের চর্চা পল্লবিত হয় সিউড়ি ও লাভপুরে। এ ক্ষেত্রে নির্মলশিব বন্দোপাধ্যায়ের নাম উল্লেখযোগ্য। তিনি লাভপুরের জমিদার পরিবারের সন্তান। আদ্যন্ত থিয়েটারপ্রেমী। এক জন অভিনেতা হিসাবে তিনি যেমন অগ্রগণ্য ছিলেন, তেমনই ছিলেন নাট্যকার। তাঁর বীররাজা, রাতকানা প্রভৃতি নাটক কলকাতার রঙ্গমঞ্চে অভিনীত হত। বীরভূমে থিয়েটারকে জনপ্রিয় ও আকর্ষণীয় করে তোলার ক্ষেত্রে নির্মলশিবের ভূমিকা অগ্রগণ্য। হেতমপুরের রাজ পরিবারের মতো লাভপুরের জমিদার পরিবারও ছিল থিয়েটারপ্রেমী। নির্মলশিবের উদ্যোগে লাভপুরে গড়ে উঠল বন্দেমাতরম থিয়েটার। এখানেও তৈরি হল বড় মাপের থিয়েটার মঞ্চ। নির্মলশিবের প্রয়াত সহোদর অতুলশিবের স্মৃতিতে নির্মিত অতুলশিব মঞ্চ শতবর্ষের চৌকাঠ ডিঙিয়ে আজও লাভপুরে বর্তমান। এই মঞ্চ নির্মিত হয়েছিল কলকাতার মঞ্চের আদলে।

লাভপুরে নির্মলশিবের সূত্রে কলকাতার প্রথিতযশা নটনটীরা আসতেন। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য নরেশ মুখোপাধ্যায়, অপরেশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়, নরেশ মিত্র, ক্ষীরোদপ্রসাদ বিদ্যাবিনোদ। নির্মলশিবের প্রেরণাতেই কথাসাহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় লাভপুরের নাট্যচর্চায় নিজেকে জড়িয়েছিলেন নিবিড় ভাবে। লাভপুরের মঞ্চে তারাশঙ্করের লেখা নাটক যেমন মঞ্চস্থ হয়েছে, তেমনই তারাশঙ্কর নিজেও লাভপুরে বিভিন্ন নাটকে অভিনয় করেছেন। লাভপুরের মঞ্চে তারাশঙ্করের অভিনীত উল্লেখযোগ্য নাটকগুলি হল চিরকুমার সভা (শ্রীশ), শেষরক্ষা (বিনোদ, চন্দ্র), বৈকুণ্ঠের খাতা (কেদার), বশীকরণ (ভৃত্য), মারাঠা তর্পণ (নসীরাম), কর্ণার্জুন (শকুনি)। এ ছাড়া প্রফুল্ল, সীতা, চাঁদবিবি, প্রতাপাদিত্য প্রভৃতি নাটকে নারী চরিত্রেও তিনি অভিনয় করেছিলেন। লাভপুরের মঞ্চাভিনয়ে কিছু উল্লেখযোগ্য নাম হল সত্যনারায়ণ বন্দ্যোপাধ্যায়, নিত্যনারায়ণ বন্দ্যোপাধ্যায়, নিত্যগোপাল মুখোপাধ্যায়, হরিপ্রসাদ সরকার, বঙ্কিম মুখোপাধ্যায় প্রমুখ। তারাশঙ্করের দুই পুত্র সনৎ, সরিৎও অভিনয় করেছেন অতুলশিব ক্লাবের নাটকে। অতুলশিব ক্লাব লাভপুরে থিয়েটার চর্চায় উল্লেখযোগ্য। পরবর্তী কালে লাভপুরে শখের থিয়েটারে উল্লেখযোগ্য নাম মহাদেব দত্ত, শশাঙ্ক সরকার, সুপ্রভাত মিশ্র।

এ প্রসঙ্গে বলা দরকার শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথের প্রচেষ্টায় থিয়েটার হয়েছে। জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে জ্যোতিদাদার হাত ধরে থিয়েটারে নেমেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। সেই তিনি শান্তিনিকেতনে ছাত্র-শিক্ষকদের নিয়ে থিয়েটার করেছেন। বীরভূমের থিয়েটারে ইতিহাসে এটা উল্লেখযোগ্য অবশ্যই।

সিউড়ির নাট্যচর্চাতেও নির্মলশিব অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিলেন। ১৯২৬ সালে তিনি সিউড়িতে গুরুসদয় মঞ্চ নির্মাণ করেন। তার আগে ১৯১৬ সালে তিনি নাট্যসমাজ নামে নাট্যদল গঠন করে থিয়েটার করেন। শরৎচন্দ্র মুখোপাধ্যায়, দেবেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, সাতকড়ি সাহা প্রমুখের নামগুলিও উল্লেখযোগ্য। কড়িধ্যা, কুরুমগ্রামের মতো গ্রামেও তখন শখের থিয়েটার চর্চা ছড়িয়েছিল। ১৯৪০-’৪১ সালে দেবরঞ্জন মুখোপাধ্যায়, অনিল সাহা, অভয় দাস, মোহিত বন্দ্যোপাধ্যায়রা জোরকদমে থিয়েটার শুরু করেন। তখন স্বাধীনতা সংগ্রামে ভারত উত্তাল। ঐতিহাসিক নাটক প্রাধান্য পেত শখের থিয়েটারে। বেণীমাধব ইনস্টিটিউশনের প্রাক্তনী সম্মেলন থেকেও জেলা পেয়েছিল বেশ কিছু ভাল নাটক।

অন্য দিকে তখন গড়ে উঠেছে গণনাট্যের বিভিন্ন শাখা। শখের থিয়েটার ক্রমশ দায়বদ্ধতার থিয়েটার হতে শুরু করল। তবু মিশরকুমারী, সাজাহান, মেবারপতন নাটক বারবার অভিনীত হয়েছে শখের থিয়েটারের মঞ্চে।

এর পরের সময়কালটি গ্রুপ থিয়েটারের যুগ। সিউড়ি, বোলপুর, রামপুরহাট, সাঁইথিয়া, নলহাটির পাশাপাশি লাভপুর, আমোদপুর, ময়ূরেশ্বরেও তৈরি হল গ্রুপ থিয়েটারের দল। তবে ১৯৫৬ সালে জেলার সেরা শিল্পীদের নিয়ে গড়ে ওঠা মঞ্চকেন্দ্রম জেলার থিয়েটার চর্চায় স্বাধীনতা উত্তরকালে গর্বিত সংযোজন। ফেরারী ফৌজ, পথিক, বিসর্জন, দুই পুরুষ, কালিন্দী প্রভৃতি মঞ্চকেন্দ্রমের গর্বিত প্রযোজনা। সারা জেলার বিভিন্ন মঞ্চে মঞ্চকেন্দ্রম দর্শনীর বিনিময়ে থিয়েটারে অভ্যস্ত করতে চেয়েছিল জেলাবাসীকে। মঙ্গল চৌধুরী, অভয় দাস, তপন মুখোপাধ্যায়, আশানন্দন চট্টরাজেরা মিলেছিলেন মঞ্চকেন্দ্রমে।

সেই গ্রুপ থিয়েটার আজও চলছে জেলার গ্রাম শহরে। গড়ে উঠেছে নানা দল। আবার পঞ্চাশ, চল্লিশ, ত্রিশের চৌকাঠ পেরিয়েও বেশ কিছু দল থিয়েটার করছে। এ ভাবেই শখের থেকে গ্রুপ থিয়েটারের দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে বেঁচে আছে বীরভূমের থিয়েটার।

লেখক নাট্যকর্মী, সাঁইথিয়া অভেদানন্দ মহাবিদ্যালয়ের প্রাক্তন গ্রন্থাগারিক (মতামত ব্যক্তিগত)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Group Theatre Bahurupi
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE