Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

রাজ্যের নামবদল নিয়ে কেন এই চাপানউতোর?

সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গের নাম ‘বাংলা’ হবে না বলে জানিয়েছেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। তার পরেই শুরু হয়েছে তরজা। লিখছেন দেবোত্তম চক্রবর্তী কিন্তু সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গের নাম ‘বাংলা’ হবে না বলে জানিয়েছেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ।

শেষ আপডেট: ২৪ জুলাই ২০১৯ ০৩:৫৪
Share: Save:

বাম আমলে প্রথমে ১৯৯৯ এবং পরে ২০১১ সালে রাজ্যের নাম পরিবর্তন করার প্রস্তাব গৃহীত হলেও সর্বসম্মত ভাবে তা সমর্থিত না হওয়ায় রাজ্যের নামবদলের ব্যাপারে খুব একটা এগনো যায়নি।

অতঃপর রাজ্যে রাজনৈতিক পালাবদলের পর বিষয়টি নিয়ে ফের চিন্তাভাবনা শুরু হয়। ২০১৬ সালের ২৯ অগস্ট রাজ্য বিধানসভায় পশ্চিমবঙ্গের নাম পরিবর্তন করে ‘বাংলা’ করার প্রস্তাব পাশ হলেও সেখানে বলা হয়েছিল ইংরেজিতে এই নাম হবে ‘বেঙ্গল’ আর হিন্দিতে হবে ‘বঙ্গাল’। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার এক চিঠিতে রাজ্যের একটি মাত্র নামের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা জানালে রাজ্য সরকার তিন ভাষাতেই রাজ্যের নাম ‘বাংলা’ করার সিদ্ধান্ত নেয়। বিধানসভায় ২০১৮-র ২৬ জুলাই সেই সিদ্ধান্ত সর্বসম্মতভাবে পাশও হয়।

কিন্তু সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গের নাম ‘বাংলা’ হবে না বলে জানিয়েছেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। নাম পরিবর্তন না করার কারণ হিসেবে তিনি বলেছেন যে, নাম পরিবর্তন করতে হলে সংবিধান সংশোধন করে যে বিল পাশ করানোর দরকার, তা হয়নি বলেই রাজ্যের নাম পরিবর্তন করা সম্ভব নয়। এই পরিস্থিতিতে শুরু হয়েছে রাজ্যের নামবদল নিয়ে রাজনৈতিক তরজা। কিন্তু কেন বারবার রাজ্যের নামবদল নিয়ে এই চাপানউতোর?

রাজ্যের বর্তমান এবং প্রাক্তন সরকারের মুখপাত্রদের বক্তব্য এই যে, যেহেতু রাজ্যের নাম ইংরেজি বর্ণমালার ডব্লিউ দিয়ে শুরু হয়, সেহেতু সর্বভারতীয় স্তরে রাজ্যের ডাক পড়ে সবার শেষে। এ ক্ষেত্রে অন্য রাজ্যসমূহ তাদের দাবিদাওয়া পেশ করার যে সুযোগ পান, কেবল মাত্র রাজ্যের নামের কারণেই সে ব্যাপারে পিছিয়ে পড়েন পশ্চিমবঙ্গের আধিকারিকেরা। সে হিসাবে রাজ্যের নাম ইংরেজি বর্ণমালার প্রথম সারিতে থাকলে সেই অসুবিধা দূর হতে পারে। আসুন দেখা যাক, কতটা যুক্তিযুক্ত সেই দাবি।

প্রথমত, স্বাধীনতার পর গত ৭০ বছরে অনেক বড় রাজ্য ভেঙে নতুন রাজ্যের জন্ম হয়েছে। আজ অবধি কোনও রাজ্য যদি নাম না বদলিয়ে দিব্যি চালাতে পারে, তবে পশ্চিমবঙ্গের একার সমস্যা হওয়ার কথা নয়। নিরীহ ‘ডব্লিউ’ যদি সব দোষের ভাগীদার হয়, তবে সব চেয়ে গুরুত্ব পাওয়ার কথা অরুণাচল প্রদেশ, অসম বা বিহারের। একই যুক্তিতে মহারাষ্ট্রের উন্নতি করার কথা মধ্যপ্রদেশ, মণিপুর কিংবা মিজোরামের সঙ্গে তাল মিলিয়ে।

কিন্তু বাস্তবে তা আদৌ হয়নি। বরং আমরা দেখেছি, উত্তরপ্রদেশ এত দিন এই ‘সমস্যা’-র মুখোমুখি হওয়ার পরেও ওই রাজ্যটা ভেঙে নতুন রাজ্যের নাম হয়েছে উত্তরাখণ্ড এবং এত দিন ‘সুবিধাপ্রাপ্ত’ অন্ধ্রপ্রদেশকে ভেঙে নতুন রাজ্য হয়েছে তেলঙ্গানা।

দ্বিতীয়ত, অনেকে রাজ্যের নতুন নাম সমর্থনের প্রসঙ্গে এমনও বলছেন যে, যেহেতু ‘পূর্ববঙ্গ’ বলে বর্তমানে কোনও কিছুর অস্তিত্ব নেই তাই খামোখা ‘পশ্চিমবঙ্গ’ নামেরও দরকার নেই। তাঁরা এ প্রসঙ্গে যে কথাটা ভুলে যাচ্ছেন, সেটা হল— এ দেশে কিন্তু উত্তরপ্রদেশ থাকলেও ‘দক্ষিণপ্রদেশ’ অথবা মধ্যপ্রদেশ থাকলেও ‘উচ্চ’ বা ‘নিম্নপ্রদেশ’ নেই । বাংলাকে দু’টুকরো করা হয়েছে, তার সঙ্গে মিশে আছে বঞ্চনার দীর্ঘ ইতিহাস— সে সবও ভুলে যেতে হবে? র‌্যাডক্লিফের ছুরির ডগায় নির্মিত হয়েছিল যার ভূগোল, তার ইতিহাস কোন ছুরির ভয় দেখিয়ে ভুলিয়ে দেওয়া হবে?

তৃতীয়ত, কেন চিরকাল ইংরেজি বর্ণ অনুসারে রাজ্যগুলোর নাম ডাকা হবে? সংবিধান স্বীকৃত সমস্ত ভারতীয় ভাষায় আগে স্বরবর্ণ, পরে ব্যঞ্জনবর্ণ। সে হিসেবে উত্তরপ্রদেশ, উত্তরাখণ্ড অনেক এগিয়ে থেকে শুরু করতে পারে এবং পশ্চিমবঙ্গের অনেক পরে ডাক আসতে পারে মহারাষ্ট্র, হিমাচল প্রদেশ, হরিয়ানা বা রাজস্থানের। যে সব রাজ্য বঞ্চিত হয়েছে এত দিন, তারাই যদি এ ব্যাপারে অগ্রণীর ভূমিকা পালন করে তা হলে সমস্যার সুরাহা হতে পারে। আর যদি প্রচলিত ব্যবস্থাই জারি থাকে, তবে রোটেশন প্রথা অর্থাৎ এক বার এ থেকে জেড, পরের বার ঠিক তার উল্টো ভাবে রাজ্যের নাম ডাকা চালু করা যেতে পারে। কেন কিছু রাজ্য শুধু নামের জন্য অন্যায় সুবিধা ভোগ করে যাবে চির দিন? অহেতুক অর্থের অপব্যয়, অসংখ্য শ্রমদিবস নষ্ট হওয়া, নানা স্তরে সরকারি জটিলতা — সমস্ত কিছু এড়াতে তাই রাজ্যের নাম যেমন ছিল তেমনই থাকুক। অবশ্য যে বাঙালি জুতোর নাম দেয় ‘অবিমৃষ্যকারিতা’, ছাতার নাম ‘প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব’ আর গাড়ুর নাম ‘পরমকল্যাণবরেষু’ সেই বাঙালি যে ভবিষ্যতে আবারও রাজ্যের নামবদল নিয়ে লড়াইয়ের ময়দানে নামবে না, সে ব্যাপারে নিশ্চিত করে বলা দুষ্কর!

আমঘাটা শ্যামপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের ইংরেজির শিক্ষক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Mamata Banerjee TMC Amit Shah BJP West Bengal
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE