Advertisement
১৯ জানুয়ারি ২০২৫

অধোগতি

বৃহস্পতিবার বেলঘরিয়া থানায় লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন নওদা পাড়ার বাসিন্দা ওই তরুণী। তাঁর অভিযোগ, সন্ধ্যায় স্বামী, কন্যা-সহ অটোর লাইনে দাঁড়িয়ে ছিলেন তিনি।

টুইটারের সিইও জ্যাক ডরসি।—ছবি রয়টার্স।

টুইটারের সিইও জ্যাক ডরসি।—ছবি রয়টার্স।

নিজস্ব সংবাদদাতা
শেষ আপডেট: ২৩ নভেম্বর ২০১৮ ০০:৩৮
Share: Save:

কেবল হিন্দু ধর্ম নহে, হিন্দু ধর্মের মধ্যে যে ব্রাহ্মণ্যবাদী পিতৃতন্ত্রের ধারা, তাহাকেই আধুনিক ভারত বরণ করিতে চাহে— সাম্প্রতিক টুইটার-নাট্য তাহার প্রমাণ। যাহারা বলে ব্রাহ্মণ্যবাদী পিতৃতন্ত্র নিপাত যাক, তাহারা এই ভারতের শত্রু। এই ভারতে তাহাদের গলবস্ত্রে ক্ষমা চাহিতে হয়। টুইটার কোম্পানির সহ-প্রতিষ্ঠাতা ও সিইও জ্যাক ডরসি-কে একটি ছবিতে এমন একটি বার্তালেখা প্ল্যাকার্ড-হাতে দাঁড়াইয়া থাকিতে দেখিয়া ভারতীয় টুইটারবিশ্বে প্রবল সমালোচনা ও গালিগালাজের প্লাবন বহিল, এবং শেষ পর্যন্ত ডরসির তরফে টুইটার ক্ষমাপ্রার্থনা করিল। এই একটি ঘটনাই প্রমাণ করিয়া দেয়, গত কয়েক বৎসরে— নির্দিষ্ট করিয়া বলিতে গেলে, নরেন্দ্র মোদীর প্রধানমন্ত্রিত্বকালে— ভারতীয় বাস্তব কতখানি পাল্টাইয়াছে। পরিবর্তনটি আরও লক্ষণীয় এই জন্য যে ডরসি সত্যই কিছু উৎসাহভরে প্ল্যাকার্ডটি প্রদর্শন করিতেছিলেন না, বরং বেশ অনিচ্ছুক শারীরভঙ্গিতেই তাহা ধরিয়া ছিলেন। কিন্তু ব্রাহ্মণ্যবাদী পুরুষতন্ত্র সেটুকুই বা সহিবে কেন। এমন একটি বার্তা দিয়া সমাজের এক শ্রেণির বিরুদ্ধে বিদ্বেষ ও বিরুদ্ধতা প্রচার করা হইতেছে, অর্থাৎ বার্তাটি বিভেদকামী— এমন একটি আশ্চর্য যুক্তি দর্শাইয়া টুইটারকে ক্ষমাস্বীকারে বাধ্য করা হইল। বয়কট, ভয়প্রদর্শন ইত্যাদির মাধ্যমে ভারতীয় সমাজে প্রগতিশীলতার চিহ্নগুলিকে এই ভাবেই অবলুপ্ত করিবার আয়োজন চলিতেছে। এই দেশে এখন প্রগতিশীল মূল্যবোধ ও মুক্তচিন্তা, দুই-ই আক্রমণযোগ্য শত্রু। কিছু দিন আগেও এই বাক্যটি উচ্চারণ করিলে হয়তো কিছু লোক ক্ষুব্ধ হইতেন, কিন্তু তাঁহাদের ক্ষোভকে প্রকাশ্য করিয়া তুলিবার ব্যবস্থা করিতেন না। কেননা, তাঁহারা জানিতেন, মুক্তচিন্তা ও প্রগতির পক্ষেও কথা বলিবার অনেক লোক আছেন, সুতরাং তাঁহাদের ক্ষোভ হালে পানি না-ই পাইতে পারে। মোদীযুগ সামাজিক ক্ষমতার ভারসাম্যটি দ্রুত পাল্টাইয়া দিয়াছে। ব্রাহ্মণ্যবাদী পিতৃতন্ত্রের ধ্বজাধারীরা এখন কেবল ক্ষমতাদণ্ডের ধারকবাহক নহেন, তাঁহাদের অনুচরবৃন্দ গোটা দেশে দাপাইয়া বেড়াইতেছে। কেবল ধর্মবিভেদের উপর ক্ষমতার ভর রাখিতে তাঁহারা সম্মত নন, জাতিভেদ ও লিঙ্গভেদও তাঁহাদের নিকট সমান আদরণীয়।

সুতরাং টুইটার-ঘটনার প্রেক্ষিতে সমাজতত্ত্ববিদরা যে মন্তব্য করিয়াছেন— এই দেশে গত দুই শত বৎসরে যতখানি সামাজিক প্রগতি সম্ভাবিত হইয়াছিল, তাহা ক্রমে পশ্চাৎপদতার অন্ধকারে বিলীন হইতে বসিয়াছে— তাহা একেবারে যথার্থ। ব্রাহ্মণ্যবাদ ও পুরুষতন্ত্র— এই দুইটি সমাজদর্শনের বিরুদ্ধেই গত দুইটি শতকে ভারতীয় হিন্দু সমাজ বহু বিদ্রোহ দেখিয়াছিল, বহু বাধাবিপত্তি পার হইয়া আসিয়াছিল, আংশিক হইলেও সামাজিক মুক্তির পথ দেখাইতে পারিয়াছিল। জাতিভেদ প্রথা বা পুরুষতান্ত্রিক প্রাধান্য নিশ্চয়ই অবলুপ্ত হয় নাই, তবে তাহাদের বিরুদ্ধ পক্ষও যে যথেষ্ট শক্তি ধরে, ইহা তাহাদের মানিতে হইয়াছিল। রাজা রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, জ্যোতিরাও ফুলে কিংবা ভীমরাও অম্বেডকররা প্রগতির যে শিখাটি জ্বালাইয়া গিয়াছেন, তাহা নিভাইবার প্রয়াসটিই আজ মূলস্রোত— বাকি সব ক্রমশই প্রান্তবর্তী, অনুল্লেখযোগ্য, অথবা পরাজিত। শেষে একটি কথা না বলিলেই নয়। সোশ্যাল মিডিয়া বলিয়া যে ‘বিপ্লব’টিকে সমাজে ‘মুক্তি’ আনিবার জন্য সাধারণত শতমুখে প্রশংসা করা হয়, তাহার সম্পর্কে একটি পুনর্বিবেচনা জরুরি। এই বিপ্লব কি সত্যই মুক্তি আনিতেছে? না কি নিজেকে ক্রমশ তাহার গ্রাহকসমাজের উপযুক্ত করিয়া তুলিবার জন্য বদ্ধ মানসিকতায় নিজেকে অন্বিত করিতেছে? ব্যবসার খাতিরে এত বড় একটি প্রতিষ্ঠানকে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রশ্নে রাতারাতি নতিস্বীকার করিতে দেখা একটি বড় মাপের দুর্ভাগ্য, সন্দেহ নাই।

অন্য বিষয়গুলি:

Jack Dorsey Twitter CEO Apology
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy