Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
সেনেটে রিপাবলিকানরা, তাঁদের পিছনে ট্রাম্প ও তাঁর প্রভাব
U.S Presidential Election 2020

বেচারা জো বাইডেন

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে অনেকেই ক্ষমতার তুলাদণ্ডে বসিয়ে ট্রাম্পের সঙ্গে তুলনা করেন। সেটি পুরো সত্য নয়।

‘আসুন’: জো বাইডেন প্রেসিডেন্ট হচ্ছেন, এই খবর জানার পরে ডেমোক্র্যাট দলের সমর্থকদের উল্লাস। সান ফ্রান্সিসকো, ৭ নভেম্বর। এএফপি

‘আসুন’: জো বাইডেন প্রেসিডেন্ট হচ্ছেন, এই খবর জানার পরে ডেমোক্র্যাট দলের সমর্থকদের উল্লাস। সান ফ্রান্সিসকো, ৭ নভেম্বর। এএফপি

সুমিত মিত্র
কলকাতা শেষ আপডেট: ১০ নভেম্বর ২০২০ ০১:৪২
Share: Save:

আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের পরাজয় কিন্তু পূর্ববর্তী নির্বাচনের মতো নয়। ট্রাম্প শেষ পর্যন্ত হোয়াইট হাউস ত্যাগ করলেও তাঁর প্রভাব রয়ে যাবে কোনও অশরীরী আত্মার মতো। এক বার সে কাউকে বশীভূত করলে তার আর নিস্তার নেই।

ট্রাম্পের সঙ্গে জো বাইডেনের প্রাপ্ত ভোটের ব্যবধান ৭.৪ বনাম ৭ কোটি। সকলে ভেবেছিল তফাত হবে অনেক বেশি। কিন্তু তা হয়নি। ২০১৬’র তুলনায় কোনও বিশাল সামাজিক গোষ্ঠীই ব্যাপক হারে সমর্থন বদল করেনি। অথচ গত মে মাসে মিনিয়াপলিস শহরে শ্বেতাঙ্গ পুলিশের হাতে এক আফ্রিকান আমেরিকানের হত্যা, এবং পরবর্তী ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’ আন্দোলনের পর, বাইডেনের দিকে সংখ্যালঘুদের বাড়তি সমর্থনই ছিল প্রত্যাশিত। তা কোথাও কোথাও হয়েছে, যেমন জর্জিয়ায়। কিন্তু ফ্লোরিডায় কিউবা থেকে আগত ল্যাটিনোদের ভোট ট্রাম্পের বাক্সে পড়েছে অনেক বেশি। হ্যাঁ, শ্বেতাঙ্গ পুরুষেরা এ-বারে বাইডেনকে সমর্থন করেছেন একটু বেশি, ট্রাম্পকে একটু কম। কিন্তু ট্রাম্পের বিপক্ষে ‘ল্যান্ডস্লাইড’ যাকে বলে, তার চিহ্নমাত্রও নেই।

এর ফল বাইডেনের পক্ষে বিষময় হতে পারে। বিলেতের এক সংবাদপত্রের মতে, শুরু থেকেই বাইডেনের একটি হাত রইবে তাঁর পৃষ্ঠদেশে বাঁধা। এই ভবিষ্যদ্বাণীকে আর এক পোঁচ মর্মান্তিক বানিয়ে নামজাদা কলাম-লিখিয়ে (ও নোবেল-জয়ী অর্থনীতিবিদ) পল ক্রুগম্যান প্রশ্ন তুলেছেন: ইজ় আমেরিকা বিকামিং আ ফেলড স্টেট? এ-প্রশ্ন অযৌক্তিক নয়, কারণ ট্রাম্প নিজে হারলেও একশো সদস্যের সেনেটের নিয়ন্ত্রণ থেকে বিপাবলিকান দলকে সরানোর রায় দেয়নি জনতা। রাজ্য-প্রতি দুই প্রতিনিধির এই উচ্চতর কক্ষে ১৯১৩ পর্যন্ত নিয়ম ছিল রাজ্যের আইনসভা থেকে প্রতিনিধি নির্বাচনের, আমাদের রাজ্যসভার মতোই। তার পর সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে সাব্যস্ত হল, সেনেটর নির্বাচন হবে সরাসরি। প্রতি দু’বছরে এক বার সেনেটের এক-তৃতীয়াংশ সদস্য সম্মুখীন হন ব্যালট পরীক্ষার।

এইখানেই মুখ থুবড়েছে ডেমোক্র্যাট দলের। সেনেটে দুই দলের বর্তমান অবস্থান: ৫৩ (রি) বনাম ৪৭ (ডে)। ডেমোক্র্যাটরা ভেবেছিলেন তাঁদের সমর্থনে পাহাড়ি ঢল নামবে, কিন্তু সাকুল্যে তাঁদের মাত্র একটি আসন লাভ হয়েছে। সেনেট নির্বাচনে কেউ ৫০ শতাংশের বেশি ভোট না পেলে ‘রান-অফ’ হয়। জর্জিয়াতে সেই রান-অফ হবে ৫ জানুয়ারি। সে-দু’টি আসন জিতলেও ডেমোক্র্যাটরা সেনেটে সংখ্যালঘু থেকেই যাবেন। তার অর্থ গভীর। প্রেসিডেন্ট অবশ্যই বিভিন্ন উচ্চপদে পছন্দসই ব্যক্তিদের নিয়োগ করতে পারেন, কিন্তু ‘নিয়ন্ত্রণ ও ভারসাম্য’ (চেক অ্যান্ড ব্যালান্স) নীতিতে অধিকাংশ গুরুত্বপূর্ণ পদে— যেমন সুপ্রিম কোর্ট ও ফেডারাল কোর্টের বিচারপতি, মন্ত্রিমণ্ডলীর সদস্য, রাজদূতকুল, বা উচ্চ প্রশাসনিক পদে— নিয়োগের জন্য সেনেটের সম্মতি প্রয়োজন। সেই সম্মতি ব্যতীত বাইডেন তাঁর পছন্দের এক জনকেও কোনও উচ্চ দায়িত্বে প্রতিষ্ঠিত করতে পারবেন না। বিদেশসচিব, অর্থসচিব, বাণিজ্যসচিব— কাউকে না। ডেমোক্র্যাটদের বামঘেঁষা নেতারা, যেমন বার্নি স্যান্ডার্স, অঙ্গীকার করেছিলেন ন্যূনতম মজুরি ঘণ্টায় ১৫ ডলার করার। কিন্তু সেনেটে সংখ্যার দৌড়ে বামপন্থীরা ট্রেজ়ারি দফতরের ধারেকাছেও ঘেঁষতে পারবেন না। ক্রুগম্যানের মতে, যত দিন না করোনাভাইরাসের নির্ভরযোগ্য প্রতিষেধক বাজারে মেলে, তত দিন কর্মচ্যুত শ্রমিক ও থমকে যাওয়া ছোট ব্যবসাকে সাহায্যের জন্য সরকারকে প্রতি মাসে ২০০ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করতে হবে। কিন্তু তার কোনও অবকাশ নেই বর্তমান সেনেটে।

বাইডেন বলছেন আমেরিকা আবার পরিবেশ সংক্রান্ত প্যারিস চুক্তিতে ফিরবে, যা থেকে ট্রাম্প সরে এসেছিলেন। এই মর্মে অবশ্যই বাইডেন নতুন অঙ্গীকার করতে পারেন, কিন্তু কার্বন-বিহীন বিদ্যুৎ উৎপাদনের খাতে সরকারি খরচ প্রয়োজন হলেই সেনেটের সম্মতি চাই। ট্রাম্প গোসা করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সঙ্গে আমেরিকার সম্পর্ক ছিন্ন করেছেন। বাইডেন তা পুনরুদ্ধার করতে পারেন, কিন্তু সংস্থার তহবিলে নতুন করে অর্থপ্রদানের অঙ্গীকার করতে সেনেটে বিল পাশ হওয়া চাই।

১৯৮৮ সালে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট জর্জ এইচ ডব্লিউ বুশকেও সেনেটে সংখ্যাল্পতার সম্মুখীন হতে হয়েছিল। কিন্তু তাঁর বিপক্ষীয় ডেমোক্র্যাটরা ছিলেন দিলদরিয়া। এখন না আছে সেই আমেরিকা, না সেই রাজনীতিকরা। সেনেটে এখন ঘুরে বেড়াচ্ছে ‘ট্রাম্পিয়ানা’র প্রেত। সেনেটের বর্তমান রিপাবলিকান নেতা মিচ ম্যাককনেল নিজে দুঁদে ডেমোক্র্যাট-বিরোধী। ফলে কোনও স্পর্শকাতর আসনে বাইডেনের পছন্দসই কারও বসার সম্ভাবনা সুদূরপরাহত। শোনা যায় বাইডেন চাইছিলেন ওবামা আমলের জাতীয় নিরাপত্তা পরামর্শদাতা সুজ়ান রাইস-কে সেক্রেটারি অব স্টেট পদে নিয়োগ করতে। একগুঁয়ে ট্রাম্প বিদেশ নীতিকে নানা ভাবে বানচাল করে দিয়েছেন, তা পুনর্গঠনের জন্য অত্যন্ত কর্মক্ষম রাইসের প্রয়োজন ছিল বাইডেনের মন্ত্রিসভায়। মিচ সেনেটে থাকতে তা আর হচ্ছে না।

আমেরিকার রাজনীতি মূলত দ্বিদলীয়। অন্তত এত কাল তাই ছিল। কিন্তু ট্রাম্পের আবির্ভাবের পর মধ্য আমেরিকার এক স্বল্পশিক্ষিত ও সঙ্কীর্ণমনা শ্বেতাঙ্গ শ্রেণি, যারা রিপাবলিকান পার্টির ভরকেন্দ্র, তারা অনুভব করেছে মানুষের মনের উপর কর্তৃত্বের নামই রাজনীতি, এবং তার জন্য বিবেকবান হওয়ার প্রয়োজন নেই। মনে আছে, প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের অনেক আগেই ট্রাম্প উঠেপড়ে লেগেছিলেন প্রমাণ করতে যে, তাঁর পূর্বসূরি বারাক ওবামার জন্ম আমেরিকায় হয়নি। কথাটি সম্পূর্ণ মিথ্যা, কিন্তু দেশের এক-তৃতীয়াংশ মানুষ তা বিশ্বাস করেছিলেন, এবং তার মধ্যে ৭২ শতাংশ হচ্ছে তালিকাভুক্ত রিপাবলিকান। এর থেকেই উদ্ভূত ধারণা, ওবামা ‘বেআইনি’ প্রেসিডেন্ট। অথবা ধরা যাক হিলারি ক্লিন্টন। তিনি সম্পূর্ণ অপ্রমাণিত অপরাধে ‘অপরাধী’! সেই জন্যই ট্রাম্পের আর্তনাদ, ‘লক আপ হিলারি’। ২০১৬ সালের নির্বাচনে যাঁরা ট্রাম্পকে ভোট দিয়েছিলেন, তাঁদের ৭০ শতাংশ নিঃসন্দেহ ছিলেন যে, হিলারি ক্লিন্টন এক জঘন্য অপরাধী!

বাইডেন আমেরিকার ৪৬তম প্রেসিডেন্ট। কিন্তু ট্রাম্প হয়েছিলেন ‘সুপার প্রেসিডেন্ট’, যাঁর কোনও অভিযোগই প্রমাণ করার প্রয়োজন নেই। তিনি এখন বলছেন বাইডেন নাকি নির্বাচনটিই ‘চুরি’ করে নিজেকে জয়ী ‘প্রতিপন্ন’ করছেন। এবং অনেক ট্রাম্প সমর্থক এখনও সে-কথা বিশ্বাস করেন! যেমন পরশুরামের গল্পে বিরিঞ্চিবাবার মুগ্ধ শ্রোতারা। বাবা ‘ক্রুসিফিকশন’কে বলেন ‘ক্রুসিফ্যাক্ট’, কারণ বাবা তো তার প্রত্যক্ষদর্শী! এই ভক্তের দলই হল ট্রাম্পের নিজস্ব ‘ভোটব্যাঙ্ক’। নেতা টুইটে হ্যাশট্যাগ ব্যবহার করেন, #বাইডেন ক্রাইম ফ্যামিলি, ভক্তেরা জানে এর অর্থ কী: বাইডেন-পুত্র যে দুর্নীতিগ্রস্ত সেই কথা সর্বত্র প্রচার করতে হবে। এই হচ্ছে ‘ডগ হুইসল’। যখন সময় হবে তখন গণতন্ত্রের ‘পীঠস্থান’-এ ট্রাম্প আবার হুইসল বাজাবেন। ২০২৪-এর আগে তো বটেই। যাতে ২০২০-র ‘ভ্রম’টি সংশোধিত হয়, হোয়াইট হাউসে ফিরে আসেন ‘সত্যের পূজারি’ ট্রাম্প, বা তাঁর পরিবারবর্গ বা ভক্তবাহিনীর কেউ।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে অনেকেই ক্ষমতার তুলাদণ্ডে বসিয়ে ট্রাম্পের সঙ্গে তুলনা করেন। সেটি পুরো সত্য নয়। সেনেটের সম্মতি ছাড়া কোনও আমেরিকান প্রেসিডেন্ট স্বৈরাচারী হতে পারেন না। কিন্তু ভারতে সংবিধানের ‘চেক’ ও ‘ব্যালান্স’কে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখিয়ে আইন পাশ হয় সংসদে বিনা আলোচনায়। বাতিল হয়ে যায় সাংসদদের সরকারকে প্রশ্ন করবার অধিকার। ৮৬ শতাংশ নোট বাতিল হয়ে যায় একটি মানুষের মর্জিতে। করোনাভাইরাস সম্পর্কে মাত্র চার ঘণ্টার নোটিসে সর্বভারতীয় লকডাউন ঘোষণা হয়। রাতারাতি গজায় ‘পিএম কেয়ারস’ তহবিল, সিএজি-র অধিকার নেই তা অডিট করার, কিন্তু সেখানে অর্থ দিলে আয়কর ছাড়। সংসদের বিভিন্ন কমিটিতে প্রস্তাবিত আইনের পরিমার্জন প্রায় হয়ই না। জম্মু-কাশ্মীরের ভারতে অন্তর্ভুক্তির পূর্বশর্ত ছিল সংবিধানের ৩৭০ ধারায় তার স্বায়ত্তশাসনের অধিকার, সেই ধারা বাতিল হয়ে যায় সংসদে আলোচনা ছাড়াই।তবে ট্রাম্প ও মোদীর মধ্যে একটি সাদৃশ্য আছে। দু’জনেরই আছে সমর্পিত-মন ভক্তমণ্ডলী। নেতা যা বলেন, তাঁদের কাছে তা-ই হল ‘ক্রুসিফ্যাক্ট’।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE