Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
Budget 2020

বাজেটে নারীশক্তি রূপকথা হয়েই রয়ে গেল

মেয়েদের প্রকল্পে ব্যয় করা অর্থের একটি নিখুঁত পরিসংখ্যান সংরক্ষণ দরকার। দেশে প্রতি তিন জনে এক জন মহিলা শ্রমিক। তাঁদের জন্য বাজেট খালি হাত। যে টুকু খবর মিলেছে বাজেট নিয়ে তাতে কিন্তু মহিলাদের জন্য তেমন সুখবর বাজেটে নেই।

জিনাত রেহেনা ইসলাম
শেষ আপডেট: ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২০ ০৭:২৩
Share: Save:

চুলের কাঁটা-ক্লিপ থেকে টি–কফি মেকার। গ্যাসের উনুন থেকে রান্নার বাসন। চিরুনি থেকে হেয়ার-ড্রায়ার। কাজের জিনিসগুলো নাগাল পেরলো বুঝি! শখের ফার্নিচার থেকে নকল ফুল। গিন্নিদের ঘর সাজানোর সামগ্রীও দামি হয়ে গেল। উপার্জনক্ষম মেয়েদের আয়করের একরৈখিক হিসেবে বদল। তবে কি সত্যিকারের লাভ হল? নাকি বিড়ম্বনা বাড়ল? দ্বিধা কাটাতে বিশেষজ্ঞদের খোঁজ জারি।

যে টুকু খবর মিলেছে বাজেট নিয়ে তাতে কিন্তু মহিলাদের জন্য তেমন সুখবর বাজেটে নেই। ‘মেয়েদের সব সুবিধে দিতে উৎসাহ দেবে সরকার’ গত বাজেটের এই প্রতিশ্রুতিতে মহিলা কৃষক থেকে বিড়ি শ্রমিক স্বপ্ন বুনতে শুরু করেছিলেন। এই বছর নতুন মিলল ত্রিমাত্রিক থিম। দেশ, সমাজ, আর্থিক উন্নতির মডেলে আলাদা করে মেয়েদের কর্মসংস্থান ও দক্ষতার স্তর অনুযায়ী পারিশ্রমিকের বৈষম্য দূর করা নিয়ে কথা উঠলই না। ‘ভারত কি লক্ষ্মী বেটি’র দল প্রদীপের তলার অন্ধকারের মতো পড়ে রইল।

বাজেট-দলিলের অসমাপ্ত দুই পাতার মতোই থেকে গেল সম্বোধনহীন সমস্যার পাহাড়। ‘দেশের সব জেলায় মহিলা কর্মসংস্থানে জোর’ দেওয়ার মিষ্টি গল্প সেনসেক্সের রেকর্ড পতনের মধ্যে দিয়ে হারিয়ে গেল। দিকভুল মন্দার অর্থনীতি প্রেমময় দেশের ‘ডাল হ্রদে পদ্মের মতো প্রস্ফুটিত’ হয়ে থাকল।

কৃষকদের আয় দ্বিগুন করার জন্য ১৬ রকমের অ্যাকশন প্ল্যান ঘোষণা ও বরাদ্দ ২.৮৩ লক্ষ কোটি টাকায় স্বস্তি নেই এক যুগের বেশি মাঠে পড়া থাকা কৃষক মৌসুমি বিশ্বাসের । তাঁর ভাষায়, “কৃষিতে ভর্তুকি আসলে এক ধরনের প্রতারণা। কৃষি যন্ত্রপাতি ও সার কিনতে গিয়ে তা ধরা পড়ছে।’’ প্রধানমন্ত্রী ফসল বিমা যোজনার অনলাইন ফর্ম ভরা পেরিয়েছে দুই বছর। সে টাকা আজও হাতে আসেনি মৌসুমিদের। এ বার কৃষি বাজেটে বলা হয়েছে সেলফ হেল্প গ্রুপের গ্রাম স্টোরেজ স্কিমের মধ্যে দিয়ে গ্রামে মেয়েরা ধনলক্ষ্মী হিসেবে মর্যাদা ফিরে পাবেন। মৌসুমি ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, “এ নিয়ে মহিলা কৃষকদের কী হবে? আজ পর্যন্ত দেশে চাষিবোন শব্দটাই জনপ্রিয় হল না। নেই মহিলা কৃষকদের পেনসনও।’’

অসংগঠিত মহিলা শ্রমিকদের দিশেহারা অবস্থা। মালতি মান্ডি গত বছর ইটভাটায় সিমেন্টের ইট বানানোর কাজে গিয়েছিলেন। সেখানে ছেলেদের চেয়ে আশি টাকা থেকে একশো কুড়ি টাকা কম রোজে খেটে এসেছে। মালতিকে বাজেটের কথা জিজ্ঞাসা করতেই সে উত্তর দেয়, “ঘরে খাটার পারিশ্রমিক পাই না, সরকার বাইরে খাটার পয়সা ঠিক করে দেয় না।’’ মহিলা বিড়ি শ্রমিকরাও এলাকাভিত্তিক মজুরির তারতম্যের শিকার। নেই পেনসনের ব্যবস্থা। দেশে প্রতি তিন জনে একজন মহিলা শ্রমিক। তাঁদের জন্য বাজেট বরাবর খালি হাত। পটগানশিল্পী দুলালী চিত্রকর হতাশ সুরে বলেন, “বাজেটে বাড়ল কি মহিলা লোকশিল্পীদের ভাতা?”

বেতনভোগী মহিলাদের কাছে বাজেট কি খুব মনোরম? প্রথম মহিলা অর্থমন্ত্রীর দ্বিতীয় দফার বাজেটে নেই মেয়েদের জন্য আলাদা আয়কর ছাড়ের ব্যবস্থা। নেই গৃহঋণে বাড়তি ছাড়ের ঘোষণা। মহিলাদের নিজেদের বাড়ি তৈরির বিষয়ে উৎসাহ দেওয়ার জন্য এটি প্রয়োজন। মাতৃত্বকালীন ছুটি আয়কর মুক্ত ঘোষণা করা জরুরি। সেটা হলে কর্মরত মায়েদের সন্তান প্রতিপালনের জন্য অর্থ সঞ্চয় করা সম্ভব। আয়া বা গভর্নেসদের বা ক্রেশের জন্য এই অর্থ ব্যয় করা যেতে পারে। নইলে বিকল্প হিসেবে স্থায়ী ‘পিতৃত্বকালীন ছুটি’ দাবির কথা রাখা যেতে পারে। ৮০ সি-এর ছাড়ের সীমা বাড়ালে বেশি সংখ্যক মেয়েদের কাজে অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে উৎসাহ বাড়বে। মহিলাদের উপার্জিত অর্থে স্বাধীন ভাবে সংসার চালানোর জন্য তাঁদের সঞ্চয় ও খরচ নিয়ে বাজেটে একটা সংবেদনশীল প্রতিফলন দেখা যেতে পারত। গৃহহিংসার হাত থেকে মুক্তির ক্ষেত্রে এইটি বড় অস্ত্র। বিবাহ বিচ্ছিন্ন ও একক অভিভাবক মায়েদের কথা বাজেটে ভেবে দেখা হয়নি। এই মহিলাদের কাজের ব্যবস্থা-প্রশিক্ষণ ও সম্মানজনক জীবনের কথা উঠে আসার কথা ছিল বাজেটে।

মহিলা কেন্দ্রিক ও মহিলার স্বপক্ষে অনেক বেশি পরিকল্পনা দেশের গণতান্ত্রিক কাঠামো ও আর্থ-সামাজিক লক্ষ্য পূরণের জন্য জরুরি। বড় বড় অঘটনের পরেও মেয়েদের সুরক্ষার জন্য মহিলা ডেস্ক ও মহিলা পুলিশ নিয়োগের জন্য ব্যয়-বরাদ্দের ঘোষণা নেই। নেই রাস্তায় বিশেষ সুরক্ষা ও আলাদা নজরদারি বাড়ানোর পরিকল্পনা বিষয়ক আলোচনা। মেয়েদের প্রকল্পের জন্য একশো শতাংশ বরাদ্দ ও তা সম্পূর্ণ ব্যবহারের ক্ষেত্রে ফারাক মেটানোর জন্য সম্পর্কিত দফতরকে প্রয়োজনীয় নির্দেশ বা গাইডলাইন বাজেট অধিবেশনেই পেশ করা দরকার। নির্ভয়া ফান্ডের ৮৯ শতাংশ অর্থ ব্যবহার না করতে পারা সেই অবহেলার পরিচায়ক। ‘বেটি বাঁচাও, বেটি পড়াও’ ও ‘উজালা যোজনার’ ব্যয়ক্রান্ত তত্ত্বাবধান ও কার্যকারিতা দেখার জন্য একটি স্বতন্ত্র দফতরের ঘোষণা বাজেটে থাকা দরকার। মেয়েদের প্রকল্পে ব্যয় করা অর্থের একটি পূর্ণাঙ্গ নিখুঁত পরিসংখ্যান সংরক্ষণ করা দরকার। এ সব এড়িয়ে মেয়েদের বিয়ের বয়স বাড়ানোর প্রসঙ্গ সামাজিক স্থবির বিচারধারার পুনরাবৃত্তি ছাড়া কিছুই নয়।

শিক্ষা ও স্বাস্থ্যে সামান্য বৃদ্ধি হয়েছে। নেই মহিলা গবেষকদের জন্য কোনও বিশেষ সুবিধা। ক্যানসার ও এইচআইভি পজিটিভ মায়েদের জন্য নেই ব্যবস্থা। অ্যাসিড আক্রান্ত, জেলবন্দি, মানসিক হাসপাতালে সেরে ওঠা মহিলাদের জন্য নেই পুনর্বাসন ও অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতার ব্যবস্থা। নেই লক্ষ্যমাত্রাভিত্তিক সুনির্দিষ্ট কোনও যোজনা। ঘরে বসে থাকা মহিলাদের শুধু স্বনির্ভর গোষ্ঠী নয়, তার বাইরেও উদ্যোগপতি হিসেবে গড়ে তোলার জন্য উৎসাহ দেখানো জরুরি। শ্রমশক্তির বিপুল অপচয় কাজে লাগাতে ও অর্থনীতিতে মেয়েদের সক্রিয় অংশ গ্রহণের জন্য বাজেটে একটা ওয়ার্ক ম্যাপের উল্লেখ ছিল জরুরি।

গ্রামীণ অর্থব্যবস্থার মেয়েদের ভূমিকা একটি দীর্ঘমেয়াদি ভাবনা। নারীকেন্দ্রিক প্রকল্পের বাইরে নারীর নেতৃত্বাধীন উদ্যোগ ও আন্দোলন গড়ে তোলার আহ্বান এ বারে নেই। মহিলাদের প্রশিক্ষণ এবং কর্মসংস্থান প্রোগ্রাম (এইটিইপি) নিয়ে নেই পরিকল্পনার রূপরেখা। অল্প সংখ্যক মেয়েদের হাতে নিজের উপার্জনের অর্থ থাকে। আক্ষরিক অর্থে তাদের গরিব হওয়ার অভিশাপ থেকে মুক্তির জন্য বাজেট এক বড় মাধ্যম।

মেয়েদের বেকারত্ব নিয়ে মরিসাসের অর্থমন্ত্রী বাজেটে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন। এমনকি প্রথা ভেঙে মেয়েদের প্লাস্টিক, টাইলসের কাজ, ড্রাইভিং, মেটালের কাজ, বাগান পরিচর্যার কাজ, বৈদুতিক কর্মী তৈরিতে এগিয়ে আসার কথা বলেছিলেন। মেক্সিকো, ব্রাজিল, পেরুতে সিভিল সোসাইটি জেন্ডার সংবেদনশীল বাজেটের জন্য সরকারের কাছে দরবার করে। আমাদের বাজেট অধিবেশন সেই সুদিন দেখার অপেক্ষায়। প্রজাতন্ত্রে প্রথমবার মহিলা সিআরপিএফ-দের বাইক স্টান্টে মুগ্ধতাই যেন তামাম দেশে নারী ক্ষমতায়নের বড় হাতিয়ার।

শিক্ষিকা, রঘুনাথগঞ্জ হাইস্কুল

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE