E-Paper

একটি বিশ্বাসের অপমৃত্যু

নতুন মন্দিরের মাহাত্ম্যে নবমর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত অযোধ্যা নগরীতে কী হয়েছিল আজ থেকে তেত্রিশ বছর আগের এই দিনে, হৃদয় খুঁড়ে সেই ইতিহাস জাগাতে আজ কে আর ভালবাসবে!

শিশির রায়

শেষ আপডেট: ০৬ ডিসেম্বর ২০২৫ ০৪:১৬

ইতিহাসের ক্লাসে শিক্ষিকাকে প্রশ্ন করে বসেছিল নাসিম, এই বিষয়টা এত বোরিং কেন? মেয়েদের খিলখিলের মাঝে টিচারের মুখেও খেলে গিয়েছিল মুচকি হাসি। সুন্দর করে বুঝিয়েছিলেন তিনি: বোরিং মানে অত সাল-তারিখ মনে রাখার ব্যাপারটা তো? তা, অতীতে কে কী করেছিল, কেনই বা করেছিল, সে নাহয় মনে রাখা গেল, কিন্তু ‘কবে’ করেছিল, সেটা মনে রাখবে না? অনেকেরই তা মনে থাকে না, এমনকি বড় বড় লোকেরও না। কিন্তু মনে রাখতে হয়। মনে রাখা আর মনে করানো— ইতিহাসের সেটাই কাজ।

এই যেমন আজকের দিনটা, ৬ ডিসেম্বর। নতুন মন্দিরের মাহাত্ম্যে নবমর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত অযোধ্যা নগরীতে কী হয়েছিল আজ থেকে তেত্রিশ বছর আগের এই দিনে, হৃদয় খুঁড়ে সেই ইতিহাস জাগাতে আজ কে আর ভালবাসবে! সইদ আখতার মির্জ়া অবশ্য বাবরি মসজিদ ধ্বংসের তিন বছরের মাথায় তৈরি করেছিলেন নাসিম নামের ছবিটা, ১৯৯৫-এ। কালে কালে তারও বয়স হল ত্রিশ বছর। হিন্দু ভারত প্রতিষ্ঠার তর্জন ও গর্জনমুখর এই সময়ে এক ঘণ্টা পঁচিশ মিনিটের এই ছোট্ট কাহিনিচিত্র দেখার সময়টুকু পাওয়া গেলে— কে বা কারা, কবে, কখন, কী করেছিল, কী-ই বা হয়েছিল তার পরে এবং পরে পরে, সেই ‘ইতিহাস’ ফিরে দেখার একটা সুযোগ হতে পারে। ইতিহাস বই বদলে গেলেও, তৈরি হওয়া সিনেমা তো আর বদলানো যাবে না!

অ্যালবার্ট পিন্টো কো গুসসা কিউঁ আতা হ্যায় বা সালিম লাংড়ে পে মত রো-র মতো ছবি বা নুক্কড়-এর মতো টিভি-সিরিয়ালের জন্য খ্যাত সইদ আখতার মির্জ়া, নাসিম ছবিটার খোঁজ বড় একটা পড়ে না। এমনকি, যে জরুরি অবস্থার পঞ্চাশ পূর্ণ হল এ বছর, সেও তিনি ও তাঁর আরও তিন বন্ধু-চলচ্চিত্রকার তুলে এনেছিলেন ১৯৭৬-এর ঘাসীরাম কোতওয়াল-এ: বিজয় তেন্ডুলকরের বিখ্যাত নাটকের চলচ্চিত্ররূপ। ঘটমান বর্তমান অনতিবিলম্বে পরিণত হচ্ছে অতীতে, বিশেষ ভাবে দেখা আর মনে রাখার মধ্য দিয়ে সেই অতীতই হয়ে উঠছে ইতিহাস— এই ভাবনা সইদদের সিনেমা নির্মাণের প্রাণনা।

নাসিম ছবিটায় আমরা যেমন দেখি ১৯৯২-এর জুন থেকে ডিসেম্বর, ক্যালেন্ডারের হিসাবে ছ’মাস আর কয়েকটা দিনের গল্প। মুম্বইয়ের এক সাধারণ মধ্যবিত্ত মুসলমান পরিবারের দিনলিপিচিত্র: বৃদ্ধ দাদাজান, ছেলে-ছেলের বৌ, যুবক নাতি মুশতাক আর কিশোরী নাতনি নাসিম, পাঁচ জনের সংসার। তিন প্রজন্ম এখানে ত্রিকালের প্রতিনিধি: অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ। বৃদ্ধ ঠাকুরদা বিছানাবন্দি, অতীতের স্মৃতিই তাঁর যাপনসঙ্গী। সেই অতীত পরাধীন, বিদেশি শক্তির পদানত ছিল, কিন্তু তাতে মিশে ছিল সম্প্রীতি, অসাম্প্রদায়িকতাও— স্বাধীনতা-পূর্ব আগরার হিন্দু-মুসলমান পরিবার ও সমাজজীবনের, দাম্পত্য ও বন্ধুত্বের সুখ ছিল। পিতামহ সেই সব ‘কিসসা’ বলেন নব্বইয়ের দশকে বড় হয়ে ওঠা পৌত্রীকে। এমন এক অতীতের কথা বলেন, যে সময়টা আর নেই। এমন এক বর্তমানে বলেন, যখন ওই ‘কহানি’গুলো বেমানান ঠেকে, কারণ চার পাশে যা ঘটছে তার সঙ্গে ওদের মেলে না কোনও মতেই। তাই ৯২’এর সেপ্টেম্বরে খুশির ইদের পারিবারিক জমায়েতে তাল কাটে— দাদাজানের মুখে মির তকী মিরের শায়েরের পাল্টা শায়ের শোনায় মুশতাকের বন্ধু জ়াফর, ফয়েজ আহমদ ফয়েজ় উচ্চারণে— কিন্তু সে এই বর্তমানের প্রতিনিধি, মুসলমানের উপর নিপীড়ন দেখেশুনে ক্লান্ত ও রাগত; সে চায় কবির কবিতাকে সময়ের আয়নায় ভিন্ন পাঠে, সময়োপযোগী ব্যাখ্যায় পড়তে। টিভির পর্দায় অহরহ মন্দির-মসজিদ দ্বন্দ্ব, সহারনপুরে থাকা স্বজনের জন্য উদ্বেগ, মুম্বইয়ের পরিস্থিতি খারাপ হচ্ছে বলে নাসিমের স্কুলে হঠাৎ ছুটি, পড়শি হিন্দু পরিবারের সঙ্গে সম্পর্কের সমীকরণে হঠাৎ মেঘ... এই সবের মধ্য দিয়েই এসে পড়ে ডিসেম্বরের ৬ তারিখ। একটা উন্মত্ত দিন, একটা উত্তেজিত ঘটনা পাল্টে দেয় বাকি ইতিহাস।

নাসিমের প্রিয় দাদাজান অসুস্থ হয়ে মারা যান সে দিনই, ৬ ডিসেম্বর। পাড়া দিয়ে যখন তাঁর শবদেহ নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, খবর আসে, গোটা মসজিদটাই ধূলিসাৎ। ঘটনার আকস্মিকতায় বিপর্যস্ত জ়াফর অস্ফুটে বলে ওঠে, যানে কা বহত সহি ওয়ক্ত চুনা হ্যায় আপ নে, দাদাজান! কিন্তু এ কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে পকেট থেকে লোহার মোটা শিকলও হাতে জড়িয়ে নেয় সে। আমরা বুঝতে পারি, এক ইতিহাস পেরিয়ে আর এক ইতিহাসের দীর্ঘ যাত্রা শুরু হবে এ বার— অস্ত্রের, শস্ত্রের, রক্তের, দ্বন্দ্বের। পরাধীনতা, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, দেশভাগ পেরিয়ে এসেও যে দাদাজান স্থিত ছিলেন সহমানুষের সম্প্রীতির ভিতে দাঁড়িয়ে থাকা মানবধর্মে, তাঁর মৃত্যু যেন খোদ অসাম্প্রদায়িক ভারতের মরণ। দূর শহরে যেন একটা ঐতিহাসিক সৌধ নয়, একটা ধর্মগোষ্ঠীর প্রার্থনাস্থল নয়, পিটিয়ে আর পিষে মারা হল বহু কষ্টে, যত্নে বাঁচিয়ে রাখা একটা বিশ্বাসকে।

ছবিটা আসলে ভারত-ইতিহাসের এক বিশেষ পর্বের ‘রিকুয়েম’, ‘এপিটাফ’, সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন সইদ আখতার মির্জ়া। এপিটাফ সে তো লেখা হয় সমাধির উপরে, জানা। কালে কালে মুছেও যায় তা, বা মুছে দেওয়া হয়। আমাদের কাজ তা ‘ইয়াদ’ রাখা। সিনেমায় দাদাজানের বলা কথাটার মতো: “আদমি কি সারে হসিয়ত, উসকি তহজ়িব, ইয়াদোঁ কা কারবার হি তো হ্যায়!”

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Babri Masjid Babri Masjid Case Babri Masjid Controversy Babri Masjid Demolition Ayodhya

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy