Advertisement
E-Paper

জেলা ঘুরে দেখা কত অজানারে

কাগজের মধ্যে কাগজের বছর ঘুরে গেল। বোঝা গেল, জোড়া বর্ধমানের চরিত্র কৃষি এবং শিল্পের ধাঁচে এক কথায় ঢেলে দেওয়া সমীচীন নয়। কারণ, অনেক। লিখছেন অনিন্দ্য মুখোপাধ্যায়কাগজের মধ্যে কাগজের বছর ঘুরে গেল। বোঝা গেল, জোড়া বর্ধমানের চরিত্র কৃষি এবং শিল্পের ধাঁচে এক কথায় ঢেলে দেওয়া সমীচীন নয়। কারণ, অনেক। লিখছেন অনিন্দ্য মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২৮ অক্টোবর ২০১৮ ০২:২৯
ইমাম রশিদি। —ফাইল ছবি।

ইমাম রশিদি। —ফাইল ছবি।

বর্ধমান জেলা (‌জোড়া) ভীষণ হীনম্মন্যতায় ভোগায়। জেলা নিয়ে কত কিছু জানি না— স্রেফ এই তালিকার দৈর্ঘ্যে।

কলকাতা শহরে খবরের কাগজের শীতাতপনিয়ন্ত্রিত দফতরে আরামকেদারায় চেপে দিব্য কাটছিল। জেলা সংস্করণ সম্পাদনার দায়িত্ব পাওয়ার পরেও। বর্ধমান জেলা নিয়ে প্রশ্নের মুখে পড়লেই, গলা খাঁকরে, ‘যতটুকু জেলা জানি...’ বলে শুরু করলে অন্তত নিরানব্বই শতাংশ ক্ষেত্রে প্রশ্নকর্তাকে থামিয়ে দিতে পারব, ছিল আস্থা। জেলার মাটি সম্পর্কে খুঁটিয়ে না জেনে, পল্লবগ্রাহী হয়ে চলছিল বেশ। বাগড়া দিল কাগজের মধ্যে কাগজ।

মহীরুহের সঙ্গে চারা। কিন্তু চারায় বটবৃক্ষের রূপ যেন দেখা যায়, প্রাথমিক ভাবনা এমনই ছিল। ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’ জেলা বর্ধমানের জন্য নিজের চেহারা বদলাবে। সেখানে মূল কাগজের সঙ্গে স্বয়ংসম্পূর্ণ ছ’পাতার একটি কাগজ পাঠকদের কাছে পৌঁছতে হবে প্রতিদিন। সেটিই ‘চারা’।

মাটি বর্ধমানের। ফলে, সে দিকে (খবরের বিষয়বস্তুর নিরিখে) চিন্তা নেই। কিন্তু ‘চারা’কে বাঁচাতে সার-জল লাগে। প্রথামাফিক ‘খাড়া-বড়ি-থোড়’ গোত্রের খবর ছেপে পাঠকের হেঁসেল পর্যন্ত পৌঁছনো সম্ভব হবে না, এটা বুঝতে রকেট বিজ্ঞানী হওয়ার প্রয়োজন নেই। সংবাদজগতে আগে দেখতাম, ‘জেলা দফতরে কাজ করি’ বললে, রসিক জনে ফুট কাটত, ‘জেলা খাটছে’। ধারণা বদলেছে। প্রান্তিকদের কাহিনি নিয়ে আলোচনা এখন অনেকেরই পছন্দ।

অতএব, জেলায় ‘পাঠকই প্রথম’ এ কথা মাথায় রেখে এগনো। সে পথে হাঁটার চেষ্টা, যেটা আগে বিশেষ মাড়ানো হয়নি। সেখানেই জন্ম পাঠকের জন্য ‘আমার’ ধারণার। পাঠক যদি একাত্ম বোধ করেন, নিজের করে নেওয়ার মতো রসদ পান তবে সে খবর বা ‘নিউজ আইটেম’-এর কাটতি ভাল হতে বাধ্য, এমনই শোনা গিয়েছে বাজার গবেষণা (মার্কেট রিসার্চ) বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে। অর্থাৎ, জেলাকে কাছ থেকে না জানলে, জেলা তোমায় জানবে না— ধারণাটি কিছুটা এ রকম। সহজ বোধবুদ্ধিও অবশ্য সে কথাই বলে।

বলা সহজ, করা নয়। অতএব, শহুরে অবোধের জেলা দর্শন শুরু, যাতে অন্তত শুঁড়টুকু ধরে গোটা হাতির আন্দাজ করতে পারে। পাঠক না বেঁধেন, ‘লেজটুকু দেখেছে’।

বর্ধমান বলতে কী বোঝ— পরীক্ষায় এমন প্রশ্ন এলে অনেক কলকাতাবাসী যে দু’টি বিষয় টানবেন তার একটি হল চাষ। ধান, আলুর। পূর্বে। অন্যটি শিল্পাঞ্চল। কয়লা, ইস্পাত আর মাফিয়ার পশ্চিম। সংবাদসচেতন যাঁরা, তাঁরা বড়জোর যোগ করবেন খাগড়াগড়। ২০১৪, গাঁধী জন্মজয়ন্তী, বোমা বিস্ফোরণ এবং তুলকালাম। কিন্তু জোড়া বর্ধমানের চরিত্র এই কৃষি এবং শিল্পের ধাঁচে এক কথায় ঢেলে দেওয়া সমীচীন নয়। কারণ, অনেক। জানতে চাইলে খুঁজতে হবে।

হ্যারি পটারের স্রষ্টা জেকে রওলিঙের অনেক আগে বধর্মানের সোনাপলাশি গ্রামের রেভারেন্ড লালবিহারী দে (১৮ ডিসেম্বর, ১৮২৪-২৮ অক্টোবর, ১৮৯২) ‘বাংলার উপকথা’কে এক মলাটে বেঁধেছিলেন। সে গল্প সঙ্কলন কোনও অংশে গ্রিম ভাইদের বা হান্স ক্রিশ্চিয়ান অ্যান্ডারসনের রূপকথা সমগ্রের চেয়ে কম উমদা নয়। বর্ধমান ঘুরে এ-স্বল্পশিক্ষিতও তেমন কিছু দেখেছে বা জেনেছে, যা তার কাছে উপাদেয় গল্প।

পশ্চিম বর্ধমানের কাঁকসায় অজয় নদ লাগোয়া এক গ্রামের কথা। গ্রামে ঢোকার রাস্তা বলতে, বালি। মাইলের পরে মাইল। শোনা যায়, সে বালি ‘পাচার’ও হয়। গ্রামে গিয়ে গ্রামবাসীর সঙ্গে কথা বলার অভিপ্রায় ছিল। বালি ঠেলে আস্তে চলছে গাড়ি। সঙ্গে গ্রামেরই এক জন।

উল্টো দিক থেকে আসছিল তিনটি ট্রাক্টর। গাড়ি দেখে মাঝপথে ট্রাক্টর ফেলে চালক এবং খালাসিরা ‘হাওয়া’ হয়ে গেলেন। ট্রাক্টর না সরলে যাওয়ার রাস্তা নেই। যখন তাঁদের খোঁজ চলছে সঙ্গীটি এক গাল হেসে বললেন, ‘‘পাবেন না। পুলিশ ভেবেছে।’’ চেয়ারে বসে ভাবতে ইচ্ছে যায়, ‘পুলিশ তো ভীষণ সক্রিয়, পাচারকারীরা গাড়ি দেখলেই পালায়!’ কান এঁটো করা হেসে ধুক করে বুক ভরা আশা নিভিয়ে দিলেন সঙ্গীটি। দাবি করলেন, ‘‘পুলিশ টাকা তোলে তো, তাই...।’’ গল্প সত্যি হয় না। তেমনতর অভিযোগ খারিজ করে দিয়েছে পুলিশও।

পশ্চিম বর্ধমানেরই আর এক এলাকা। এ বার রানিগঞ্জ। সরকারি এবং পুলিশকর্তাদের দাবি অনুযায়ী, সেখানে অবৈধ ভাবে কয়লার কারবার হয় না। হলেও তা বিক্ষিপ্ত। পুলিশ-প্রশাসন খবর পেলেই ‘অভিযান’ চালায় এবং ধরপাকড় করে। সেই ব্লকেই এক এমন খাদানে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল, যা বৈধ কি না কর্মকর্তাদের কাছে জানতে চাওয়ার সাহস হয়নি। ‘ওপেন কাস্ট’ গোত্রের সে খনির আকার, বিস্তৃতি দেখে মুখ হাঁ। ঢেঁকি ছাঁটা চালের ভাত, বাঁধাকপির ঘ্যাঁট আর দিশি মুরগির ঝোল দিয়ে ভাত খেতে খেতে সে খাদানের এক কর্তা দাবি করেন, তিনি ডাক্তারি পড়ার সুযোগ পেয়েছিলেন। পড়েননি কারণ, কয়লার ‘ব্যবসা’র টান। জয়েন্ট-আকুল এ বঙ্গে এমনও চরিত্র হয় শুনে গল্প জমে ওঠে।

এ রকম দু’চারটি অভিজ্ঞতা সবে ঝুলিতে জমছে, তার মধ্যেই গোষ্ঠী-সংঘর্ষের আগুন ছড়াল আসানসোলে। কী আশ্চর্য, সেখানেও মিলল ‘গল্প’! চরিত্র, সংঘর্ষে খুন হয়ে যাওয়া এক কিশোরের বাবা। রেলপাড়ের ইমাম রশিদি। যিনি ছেলের খুনির ধর্ম-পরিচয় জানতে চান না, অশান্তি বাড়তে পারে এই শঙ্কায়। এমন উপলব্ধি যাঁর,

তিনি মাথা নত করে দিতে পারেন অক্লেশে।

আইজাক নিউটন জ্ঞান-সাগরের পারে নুড়ি কুড়নোর বিনয় দেখিয়েছিলেন। ধৃষ্টতা মাফ, জেলা সফর শিখিয়েছে নুড়ি তো দূর, বালির কণাটুকুও জমেনি ভাঁড়ারে। কাগজের মধ্যে কাগজের এই এক বছরে এগোনো গিয়েছে কয়েক পা। তবে পা না থামলে ‘চারা’কে বনস্পতি করে তোলায় অন্য আনন্দ থাকবে।

Agriculture Bardhaman বর্ধমান
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy