বর্ষণ কতটা হইবে, বলা কঠিন। কিন্তু অন্তত গর্জন শোনা গিয়াছে, ভারতীয় গণতন্ত্রের পক্ষে ইহা কম কথা নহে। গত বুধবার কংগ্রেসের ‘অন্তর্বর্তী’ সভানেত্রী সনিয়া গাঁধী (এবং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়) আহূত ভিডিয়ো বৈঠকে অ-বিজেপি শাসিত সাতটি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীরা মোদী সরকারের অ-গণতান্ত্রিক আচরণের প্রবল নিন্দায় ক্ষান্ত হন নাই, বিরোধী দলগুলির সংগঠিত ও সক্রিয় প্রতিবাদের নূতন উদ্যোগ শুরু করিবার ডাক দিয়াছেন। কংগ্রেস-শাসিত চারটি রাজ্য ছাড়াও বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন পশ্চিমবঙ্গ, ঝাড়খণ্ড এবং মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রীরা। সংখ্যার বিচারে এই বিরোধী ‘জোট’-এর ওজন বিপুল নহে। প্রতিনিধিত্বের বৃহত্তর অঙ্কেও ইহার পরিধি সীমিত। নবীন পট্টনায়ক বা অরবিন্দ কেজরীবালের মতো মুখ্যমন্ত্রীরা বৈঠক এড়াইয়া বুঝাইয়া দিয়াছেন, তাঁহাদের হিসাব স্বতন্ত্র। পিনারাই বিজয়নও রাজ্য রাজনীতির স্বার্থে কংগ্রেসের আয়োজন হইতে নিজেকে দূরে রাখিয়াছেন। সুতরাং, এখনই আশির দশকের বিরোধী ‘কনক্লেভ’-এর উত্তরসূরি খুঁজিলে ভুল হইবে। কিন্তু রাজনীতির সম্ভাবনা সংখ্যা বা ভূগোলের গণ্ডিতে বাঁধা থাকে না। আপাতবিচারে সীমিত পরিসর হইতে বিপুল প্রতিস্পর্ধার সৃষ্টি এবং সাফল্যের বহু নিদর্শন ইতিহাসে আছে। রাজনীতির হৃৎস্পন্দন পাটিগণিতে মাপিবার নহে।
বুধবার বিভিন্ন বিরোধী নেতা ও নেত্রীর কথায় যে হৃৎস্পন্দনের স্পষ্ট সঙ্কেত মিলিয়াছে, তাহার মর্মার্থ: অনেক সহ্য করিয়াছি, আর নয়। স্পষ্টতই, কেন্দ্রীয় সরকার যে ভাবে রাজ্যের ক্ষমতা আত্মসাৎ করিতে ব্যস্ত, যে ভাবে তাহারা ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করিতে তৎপর, সেই আগ্রাসী আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধেই এই জেহাদ। এই যুদ্ধঘোষণা বিশেষ ভাবে চমকপ্রদ, কারণ বৈঠকের প্রধান আহ্বায়ক কংগ্রেস দৃশ্যত এতটা চড়া সুরে বিরোধিতার জন্য প্রস্তুত ছিল না। বস্তুত বৈঠকটির ঘোষিত উদ্দেশ্য ছিল, সংসদের আসন্ন অধিবেশনে বিরোধীদের কর্মপন্থায় সমন্বয় সাধনের প্রস্তুতি শুরু করা। কিন্তু সেই সংসদীয় সমন্বয়ের পরিধি অতিক্রম করিয়া স্থায়ী বিরোধী মঞ্চ তৈয়ারের ডাক শোনা গিয়াছে এই সভায়। এবং মোদী সরকারের অনাচারের বিরুদ্ধে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রত্যাশিত স্বরের পাশাপাশি তীব্র নিন্দা শোনা গিয়াছে মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী উদ্ধব ঠাকরের কণ্ঠেও। একাধিক মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা করিয়াছেন, ভয় দেখাইয়া চুপ করিয়া রাখিবার এই দুঃশাসন অসহ্য, ‘যাহা হয় হইবে’ বলিয়া রুখিয়া দাঁড়াইতে না পারিলে শাসকরা সম্পূর্ণ মাথায় চড়িয়া বসিবেন। নরেন্দ্র মোদী এই বিস্ফোরণে নিউটনের তৃতীয় সূত্র দেখিতেছেন কি না, তিনিই জানেন।
অতঃপর প্রশ্ন: এই প্রতিস্পর্ধাকে একটি সংগঠিত বিরোধী ঐক্যের রূপ দিবার কাজটি সম্পন্ন হইবে কি? গণতন্ত্রের স্বার্থে সেই কাজ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিরোধী রাজনীতি দুর্বল হইলে সংখ্যাগুরুর আধিপত্য কতটা বিপজ্জনক ও শ্বাসরোধকর হইতে পারে, মোদীর ভারত তাহা বিলক্ষণ বুঝিতেছে। বিরোধীদের দুর্বল এবং ছন্নছাড়া অবস্থার সুযোগে দেশের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলিকে সর্বপ্রকারে পদানত করিবার সরকারি প্রকল্প ইতিমধ্যেই অনেক দূর অবধি সম্পন্ন। কেবল সংসদে নহে, গণতন্ত্রের বৃহত্তর পরিসরেও এই আগ্রাসন প্রতিরোধ করা জরুরি। যুক্তরাষ্ট্রীয় আদর্শ সেই প্রতিরোধে একটি মৌলিক শক্তি হইয়া উঠিতে পারে, ঠিক যেমন হইয়াছিল ‘কনক্লেভ’-এর যুগে। লক্ষণীয়, ‘সহযোগিতামূলক যুক্তরাষ্ট্রীয়তা’র নামে কেন্দ্রীয় সরকার রাজ্যের স্বাধিকার হরণ করিতে বদ্ধপরিকর বলিয়াই আজ অন্তত কয়েকটি রাজ্য হইতে এমন প্রবল বিবাদী স্বর ধ্বনিত হইতেছে। এখানেই যুক্তরাষ্ট্রীয়তাকে হাতিয়ার করিয়া ভারতীয় গণতন্ত্রকে সর্বগ্রাসী এককেন্দ্রিকতার কবল হইতে মুক্ত করিবার বিশেষ সম্ভাবনা। কিন্তু সেই সম্ভাবনাকে সার্থক করিবার জন্য এখনও অনেক পথ হাঁটিতে হইবে। সেই পথ দুর্গম।