Advertisement
১০ মে ২০২৪
War

যুদ্ধ নহে, সংযম

দুই বছর আগেই ভারত-ভুটান-চিন সীমান্তে ডোকলামে অশান্তির পারদ বিপদসীমা ছাড়াইয়াছিল, তবে শেষ অবধি বিস্ফোরণ ঘটে নাই।

ছবি: পিটিআই।

ছবি: পিটিআই।

নিজস্ব প্রতিবেদন
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৮ জুন ২০২০ ০১:১৪
Share: Save:

লাদাখে ঠিক কী ঘটিয়াছে, আপাতত সেই বিষয়ে নিঃসংশয় হইবার উপায় নাই। কিন্তু চিন ও ভারত, দুই প্রতিবেশী দেশের রাষ্ট্রীয় ও অন্যান্য সূত্র হইতে যতটা শোনা— এবং জানা— গিয়াছে তাহাতে একটি উদ্বেগ অনিবার্য। উদ্বেগের হেতু: ব্যর্থ কূটনীতি। ছয় বছরে মোদী সরকারের কূটনৈতিক সামর্থ্যের প্রদর্শনীতে গৌরবের কারণ বিশেষ ঘটে নাই। বারাক ওবামাকে স্বহস্তে চা করিয়া খাওয়ানো কিংবা শি চিনফিংয়ের সহিত ঝুলনলীলা— প্রধানমন্ত্রী কেবলই দৃশ্যের জন্ম দিয়াছেন, কিন্তু জগৎসভায় ভারতের আসন উন্নত হয় নাই। বরং প্রতিবেশী দেশগুলির সহিত সম্পর্কে নানা ভাবে নূতন সমস্যা ও দুশ্চিন্তা দেখা দিয়াছে। এই দুশ্চিন্তার একটি বড় কারণ চিন। পাকিস্তানের কথা ছাড়িয়াই দেওয়া গেল, অন্য অধিকাংশ প্রতিবেশী রাষ্ট্রের উপর চিন উত্তরোত্তর প্রভাব বাড়াইয়াছে, ভারতের প্রতিপত্তি প্রায় সমানুপাতে কমিয়াছে। তাহার ফলে, বেজিংয়ের সহিত কূটনৈতিক সম্পর্কটি বুদ্ধিমত্তা ও কৌশলের সহিত বজায় রাখিবার কাজটি দিল্লীশ্বরদের পক্ষে অধুনা যতটা কঠিন, ততটাই জরুরি। এই পরিপ্রেক্ষিতেই বিশেষ ভাবে প্রয়োজনীয় ছিল চিনের সহিত সীমান্ত সংক্রান্ত বিতর্ক বা বিবাদকে কোনও ভাবে সংঘর্ষের স্তরে পৌঁছাইতে না দেওয়া।

ঘটিয়াছে বিপরীত। দুই বছর আগেই ভারত-ভুটান-চিন সীমান্তে ডোকলামে অশান্তির পারদ বিপদসীমা ছাড়াইয়াছিল, তবে শেষ অবধি বিস্ফোরণ ঘটে নাই। এ বার কয়েক সপ্তাহ ধরিয়া লাদাখে মেঘ ঘনাইয়াছে, বিভিন্ন মহল হইতে আশঙ্কার বাণী উচ্চারিত হইয়াছে, শোনা গিয়াছে কূটনৈতিক আলাপ-আলোচনার পথে উত্তেজনা প্রশমনের পরামর্শও। কেন্দ্রীয় সরকার প্রধানত নীরব থাকিয়াছে, অথবা ‘চিন্তার কোনও কারণ নাই’ নামক বাঁধা গত গাহিয়াছে। বিধ্বস্ত অর্থনীতির শ্মশানে বসিয়াও যে প্রধানমন্ত্রী পুনরুজ্জীবনের সুলক্ষণ দেখিতে পান তাঁহার সরকারের পক্ষে হয়তো ইহাই স্বাভাবিক। কিন্তু ছেঁদো কথায় শেষরক্ষা হয় নাই। এই ঘটনার জন্য নরেন্দ্র মোদীকে দায়ী করিবার ক্ষুদ্রতা অবশ্যই পরিহার্য— এমন উদ্বেগজনক ঘটনা লইয়া তুচ্ছ দোষারোপের রাজনীতি চলিতেই পারে না। কিন্তু পঁয়তাল্লিশ বছর পরে ভারত-চিন সীমান্ত সংঘর্ষে প্রাণহানির ঘটনা ঘটিল তাঁহার জমানাতেই, এই তথ্য ইতিহাসের পাতায় লেখা থাকিবে। স্বর্ণাক্ষরে নহে।

সেই অক্ষর মুছিবার সাধ্য প্রধানমন্ত্রী বা তাঁহার সহচরদের নাই। এখন তাঁহারা একটি কাজই করিতে পারেন— উত্তেজনার পারদ নামাইয়া পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা। তাহা কূটনীতির কাজ, যে কূটনীতি দুই রাষ্ট্রের দায়িত্বশীল আধিকারিকদের— প্রয়োজনে রাষ্ট্রযন্ত্রের সর্বোচ্চ স্তরে— পারস্পরিক আলোচনার মাধ্যমেই সাধন করিতে হয়। সরকারি ভাষ্যে ‘ডিএসক্যালেশন’ বা উত্তেজনা প্রশমনের কথা বলা হইয়াছে। আশার কথা। কিন্তু পাশাপাশি রহিয়াছে আশঙ্কার কথাও। সীমান্ত সংঘর্ষের সংবাদ এবং জল্পনাকে কেন্দ্র করিয়া ইতিমধ্যেই শোনা যাইতেছে উগ্র অতিজাতীয়তাবাদী নির্ঘোষ। শাসক দলের ভক্তবৃন্দ এই বিষয়ে যথারীতি তৎপর, এমনকি সেই দলের নেতৃত্বের কণ্ঠেও ‘সমুচিত জবাব’ দিবার হুঙ্কার ধ্বনিত হইয়াছে। যাহারাই যখন সরকার চালায় তাহাদের কণ্ঠস্বর এমন পরিস্থিতিতে কয়েক পর্দা চড়িয়া যায়, কিন্তু বর্তমান শাসকদের স্বাভাবিক স্বরই রণহুঙ্কারের পর্দায় বাঁধা, অতএব অশান্ত পরিস্থিতিতে তাঁহাদের আত্মসংযমের দায় কিছু বেশি। বলিবার অপেক্ষা রাখে না যে, সংযমের দায় সমস্ত রাজনৈতিক শিবিরের, এবং অবশ্যই নাগরিক সমাজের। গোটা দুনিয়ার সহিত ভারতের মানুষ এই মুহূর্তে এক গভীর সঙ্কটের কবলে। অর্থনীতির ভবিষ্যৎ সম্পূর্ণ অনিশ্চিত। যাহাতে বাড়তি উদ্বেগের সৃষ্টি না হয়, তাহা নাগরিকদেরই নিশ্চিত করিতে হইবে। ক্ষুদ্রবুদ্ধির প্ররোচনা এবং নির্বোধ অসংযমের বিরুদ্ধে যুদ্ধটিই এখন বেশি জরুরি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

War India China
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE