বেঘোরে: কাঁথির পেটুয়া ঘাট মৎস্যবন্দরে হাঙরের দেহ। নিজস্ব চিত্র
বছর চার পাঁচেক আগের কথা। দিঘা মোহনায় ভেসে এসেছিল এক তিমির দেহ। লম্বায় ফুট বিয়াল্লিশেক হবে। কী কারণে মৃত্যু বোঝা যায়নি। তবে তিমির কঙ্কালটি দিঘার মেরিন অ্যাকোরিয়ামে সংরক্ষণ করা হয়েছে। তিমিটি ব্রাইড হোয়েল প্রজাতির।
মৎস্যজীবীদের কেউ কেউ মনে করেন, তারও কয়েক বছর আগে মন্দারমণিতে আবার মিলেছিল তিমির দেহ। তার পর বহুদিন বিশাল সামুদ্রিক প্রাণী পূর্ব মেদিনীপুরের সমুদ্র উপকূলবর্তী এলাকায় পাওয়া যায়নি। সম্প্রতি খবরের শিরোনামে আসে একটি বিশাল হাঙর। পেটুয়াঘাট মৎস্যবন্দরের কাছে ভেসে এসেছিল হাঙরের দেহটি। মৎস্যজীবীদের কেউ দেহটি টেনে ডাঙায় তোলেন।
হাঙরের দেহ মেলার সপ্তাহ খানেক আগে দিঘা এবং হলদিয়ায় সামুদ্রিক প্রাণীর উপস্থিতি বারবার খবরে এসেছে। দিঘা মোহনায় ধরা পড়েছিল একটি বিশালাকায় অক্টোপাস। প্রায় কিলোখানেক ওজনের। প্রাণীটিকে দিঘার মেরিন অ্যাকোরিয়ামে রাখা হয়েছে। ওই সময়েই হলদিয়ায় ভেসে এসেছিল শুশুকের দেহ।
অক্টোপাস, হাঙর বা শুশুক গভীর সমুদ্রের প্রাণী। এরা কেন অগভীর সমুদ্রে বা উপকূলীয় অঞ্চলে বারবার চলে আসছে? এর কারণ কী? সমুদ্র বিজ্ঞানী আনন্দদেব মুখোপাধ্যায় জানাচ্ছেন গভীর সমুদ্রের প্রাণীর অগভীর সমুদ্রে চলে আসার ঘটনা খুব একটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। হাঙর গভীর সমুদ্রের প্রাণী। এই প্রাণী দলবদ্ধ অবস্থায় থাকে। কিন্তু কখনও কখনও দলছুট হয়ে এই সব এলাকায় চলে আসে। আবার কখনও খাবারের খোঁজেও পথ ভুলে চলে আসে। অক্টোপাসের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটে বলে জানিয়েছেন সমুদ্রবিজ্ঞানী আনন্দদেব। অক্টোপাসের মোহনা অঞ্চলে বারবার চলে আসার ঘটনার কথা জানিয়েছেন দিঘা মেরিন অ্যাকোয়ারিয়ামের আধিকারিক প্রসাদচন্দ্র টুডু। তাঁর কথায়, ‘‘গত বছর উপকূল এলাকায় অন্তত তিনটি অক্টোপাস ধরা পড়েছিল। এ বছর এর মধ্যেই ১১-১২টা অক্টোপাস ধরা পড়ার খবর নজরে এসেছে।’’ তিনি জানিয়েছেন, উপকূলীয় অঞ্চলে মৎস্যজীবীদের এক বিশেষ ধরনের জালে আটকা পড়ে যায় অক্টোপাস। আবার কখনও কখনও গভীর সমুদ্রে ধরা পড়ে হাঙর। কী কারণে হাঙর বা অক্টোপাস অগভীর সমুদ্র এলাকায় চলে আসে? প্রসাদচন্দ্র জানিয়েছেন, উপযুক্ত গবেষণা ছাড়া এ বিষয়ে কিছু বলাটা ঠিক হবে না।
বারবার গভীর সমুদ্রের প্রাণীর ধরা পড়ার বা অগভীর এলাকায় চলে আসার কোনও একটা কারণ তো থাকবে? কী কারণ হতে পারে? সুরজিৎ বাগ জানালেন, অক্টোপাস এবং হাঙর গভীর সমুদ্রের প্রাণী তো বটেই। শুশুকও গভীর সমুদ্রের। তবে কুকড়াহাটি, সুতাহাটা গাঙ্গেয় অঞ্চলে কিছু শুশুক থাকে। সেগুলো গাঙ্গেয় ডলফিন। কিন্তু কিছুদিন আগে হলদি নদীর তীরে যে শুশুকটির দেহ মিলেছিল সেটি কিন্তু গভীর সমুদ্রের। তাঁর কথায়, ‘‘দু’টো কারণের জন্য এই প্রাণীগুলো অগভীর জলে আসে। প্রথম কারণ, গভীর সমুদ্রে হাঙর, শুশুকেরা দলবদ্ধ হয়ে থাকে। কিন্তু খাবারের অভাবের কারণে এরা অনেক সময়ে দলছুট হয়ে পড়ে। তার পর খাবারের খোঁজ করতে করতে ঢুকে পড়ে অগভীর এলাকায়। তার পর আর ফিরতে পারে না। তখন খাবার না পেয়ে পেয়ে দুর্বল হয়ে পড়ে। তার পর এক সময়ে মারা যায়।’’ তিনি জানিয়েছেন, অনেক সময়ে দুর্বল প্রাণীগুলো মৎস্যজীবীদের জালে আটকে পড়ে। বা আঘাত পায়। তাতেই মারা যায়।
দ্বিতীয় কারণ হিসেবে সুরজিৎ বাগ জল দূষণকেই দায়ী করেছেন। তার মতে, দূষণের জন্য বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দায়ী বিদেশি মালবাহী জাহাজগুলো। উপকূলরক্ষী বাহিনীর নজরদারি সত্ত্বেও জাহাজগুলো বর্জ্য তেল বঙ্গোপসাগরের অরক্ষিত অঞ্চলে ফেলে দিয়ে পালায়। সেই কারণেই অনেক সময়ে দেখা যায় ঝাঁকে ঝাঁকে মাছ মারা যাচ্ছে। আবার দূষণের কারণে এলাকা ছাড়া হচ্ছে সামুদ্রিক প্রাণীগুলো। আগের থেকে তেল ফেলার ঘটনা কমেছে। তবে একেবারে বন্ধ হয়নি। জল দূষণের দ্বিতীয় কারণ হিসেবে সুরজিৎবাবু বিশ্ব উষ্ণায়নকে দায়ী করেছেন। উষ্ণায়নের কারণে জলের উষ্ণতা, অম্ল, ক্ষারের মাত্রার ভাল রকম হেরফের হচ্ছে। ফলে জলজ প্রাণীদের স্বাভাবিক বাসস্থান নষ্ট হচ্ছে। তারা ছড়িয়ে পড়ছে। তাঁর মতে, প্লাস্টিক দূষণের কারণেও সমুদ্র দূষিত হয়। তাঁরা উপকূলীয় গ্রামগুলোতে প্লাস্টিক ব্যবহার না করার জন্য প্রচার চালান। কিছু কাজ হচ্ছে তাতে। আবার উপকূলীয় অঞ্চলে জল বেশি দূষিত হওয়ার কারণেও প্রাণীগুলো চলে এলে আর বাঁচতে পারে না।
লক্ষ্মীনারায়ণ জানা। পরিষ্কার দাবি করলেন, বারবার অগভীর সমুদ্রে গভীর সমুদ্রের প্রাণীদের চলে আসার জন্য দায়ী আসলে মানুষ। এর পিছনে প্রাকৃতিক পরিবর্তনের থেকে মানুষের কাজই বেশি দায়ী। তিনি বললেন, ‘‘এখন মাছ ধরার ট্রলারগুলো সমুদ্রের যে জলসীমায় পর্যন্ত মাছ ধরতে তার অনেক গভীরে চলে যায়। সেই জায়গায় অত্যাধুনিক ট্রলারগুলো পুকুর গুলোনোর মতো করে সমুদ্রের জল তোলপাড় করে। ফলে গভীর সমুদ্রের প্রাণীগুলো অগভীর এলাকায় চলে আসে।’’ তিনি উদাহরণ দিলেন বাঘ, হাতির। গভীর জঙ্গলে বাঘ বা হাতির এলাকায় গিয়ে মানুষ উৎপাত করে বলেই সেই প্রাণীগুলো এলাকা ছাড়া হয়ে লোকালয়ে চলে আসে বলে মত তাঁর। গভীর সমুদ্রের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটে। তিনি আরও একটি বিষয়ের কথা উল্লেখ করলেন। এখন ট্রলারগুলো বেশ গতিসম্পন্ন। সেগুলোর গতির সঙ্গে পাল্লা দিতে না পেরে ওই প্রাণীগুলো মারা যায়। এলাকা ছাড়া হয়।
গভীর সমুদ্রে মাছ ধরার কারণে খাদ্যের অভাব হচ্ছে বলেও মত লক্ষ্ণীনারায়ণবাবুর। তিনি বলেন, ‘‘যে পর্যন্ত মাচ ধরার কথা তার থেকেও বেশি দূরত্বে গিয়ে মাছ ধরছেন মৎস্যজীবীরা। তার ফলে সেখানে ওই এলাকার বাসিন্দাদের খাবারের ভাঁড়ারে টান পড়ছে। তারা এলাকা ছাড়া হচ্ছে। এটা তো স্বাভাবিক বাস্তুতন্ত্রের নিয়ম।’’ মাছ ধরার যথেচ্ছাচারে সমুদ্রের নিয়ম লঙ্ঘিত হচ্ছে বলেই মত লক্ষ্মীনারায়ণবাবুর।
মানুষ সংযত না হলে মানুষের সঙ্গে সংঘাত বাড়বে গভীর সমুদ্রে প্রাণীর। প্রকৃতির নিয়ম।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy