Advertisement
E-Paper

খাটিয়ায় এত দোষ? জানতেই পারিনি এত দিন!

‘তেলের শিশি ভাঙল বলে খুকুর পরে রাগ করো/ তোমরা যে সব বুড়ো খোকা ভারত ভেঙে ভাগ কর!’ আজও বড্ড প্রাসঙ্গিক পঙ্ক্তিগুলো। উত্তরপ্রদেশের প্রত্যন্ত প্রান্ত দেওরিয়ার মানুষজনকে দেখে যেমন গেল গেল রব উঠেছে এবং দিল্লি, মুম্বই, কলকাতা, চেন্নাই, বেঙ্গালুরু বা হায়দরাবাদের অনেক মানুষকে দেখে তেমন রব রোজ ওঠা উচিত হলেও তা যে ভাবে ওঠে না, তাতে এই পঙ্ক্তি আবার আওড়াতেই হচ্ছে।

অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০৮ সেপ্টেম্বর ২০১৬ ০৪:০২

‘তেলের শিশি ভাঙল বলে খুকুর পরে রাগ করো/ তোমরা যে সব বুড়ো খোকা ভারত ভেঙে ভাগ কর!’

আজও বড্ড প্রাসঙ্গিক পঙ‌্ক্তিগুলো। উত্তরপ্রদেশের প্রত্যন্ত প্রান্ত দেওরিয়ার মানুষজনকে দেখে যেমন গেল গেল রব উঠেছে এবং দিল্লি, মুম্বই, কলকাতা, চেন্নাই, বেঙ্গালুরু বা হায়দরাবাদের অনেক মানুষকে দেখে তেমন রব রোজ ওঠা উচিত হলেও তা যে ভাবে ওঠে না, তাতে এই পঙ‌্ক্তি আবার আওড়াতেই হচ্ছে।

সভাস্থলে বসার জন্য একটু অভিনব ব্যবস্থা হয়েছিল। খাটিয়া পাতা ছিল। ফেরার পথে সেই সব খাটিয়াই যে যেমন পেরেছেন, নিয়ে গিয়েছেন সঙ্গে করে। গরিবগুর্বো, গ্রামীণ জনতার খাটিয়া নেওয়া দেখে হাসির রোল আর থামছে না। কটাক্ষ দেশজুড়ে। হাস্যরোলের পুরোভাগে বিজেপি। কারণ সভাটি ছিল রাহুল গাঁধীর।

বিচিত্র ‘রস’বোধ আমাদের!

প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে এক অভিনব রাজনৈতিক কর্মসূচি। ভিড় জমিয়েছিলেন যাঁরা, তাঁদের অধিকাংশই প্রান্তিক মানুষজন। সভা থেকে ঘরে ফেরার পথে পড়ে পাওয়া চোদ্দ আনা— একটা খাটিয়া হাতে করে নিয়ে যাওয়ার সুযোগ। প্রান্তিক এক জনগোষ্ঠী সে সুযোগকে অবজ্ঞার চোখে দেখতে পারেননি। এমন ছোটখাটো প্রাপ্তির সম্ভাবনাকে তাঁরা হেলাভরে প্রত্যাখ্যান করতে শেখেননি, কারণ যে নেই রাজ্যে তাঁদের বাস, সেখানে এটুকু প্রাপ্তিকেই অনেক মনে হয়। কিন্তু সে সব বিচার, বিশ্লেষণ, সহমর্মিতা আপাতত চুলোয় যাক। কারণ আমাদের অনেকেরই হাসি পেয়েছে। রাহুল গাঁধীর সভায় আসলে কেউই রাহুল গাঁধীর কথা শুনতে জড়ো হননি। খাটিয়া নেওয়ার জন্য গিয়েছিলেন। এই ‘সত্য’ প্রমাণের তাগিদ রয়েছে। অতএব হাসতে হবে উচ্চৈঃস্বরে। ব্যঙ্গ, বিদ্রূপ, কটাক্ষের বান ডাকাতে হবে।

রাহুল গাঁধীর সভা সফল হল না ব্যর্থ, সে সভায় ভিড় নেতার জনপ্রিয়তায় হল, না অন্য কোনও কারণে, সে নিয়ে বিতর্ক থাকতেই পারে। কিন্তু রাহুল গাঁধীকে হেয় দেখানোর নাট্যরঙ্গে বা কুনাট্যরঙ্গে যে ঘটনাকে কেন্দ্রীয় চরিত্র হিসেবে তুলে ধরা হচ্ছে, তাতে আসলে হেয় হচ্ছেন দেওরিয়ার প্রান্তিক মানুষগুলো। একটা খাটিয়া সভাস্থল থেকে নিয়ে গিয়েছেন বলে অজস্র কটাক্ষ, বিদ্রূপ, ব্যঙ্গ, নিন্দা, সমালোচনার বন্যায় ভেসে যাচ্ছেন তাঁরা। ভেসে যাচ্ছে মান-সম্মান।

সাত দশকের স্বাধীনতা আমাদের। তা সত্ত্বেও এ জনগোষ্ঠীর এক বিশাল অংশের কাছে একটা দড়ির খাটিয়া আজও মহার্ঘ প্রাপ্তি। দেশের শাসনভার সামলেছেন বা সামলাচ্ছেন যাঁরা, এ কটাক্ষের বর্ষণ তাঁদের উপর হওয়া উচিত। অথচ তাঁরাই ব্যঙ্গ-বিদ্রূপের বান ডাকাচ্ছেন। কখনও কখনও বলিউডি মহাতারকার আয়কর ফাঁকির ঘটনা সামনে আসে, এঁরা খুব একটা হইচই করেন না। কোনও রাজনৈতিক নেতা কয়েকশো কোটি টাকার পশুখাদ্য সাবাড় করে দিয়েও সদর্পে আইনসভায় গিয়ে বসেন, এঁরা তাঁকে অচ্ছুৎ মনে করেন না। কখনও কখনও প্রখ্যাত বা কুখ্যাত পুঁজিপতির বিপুল অঙ্কের ব্যাঙ্ক জালিয়াতি সামনে আসে, এঁরা তাঁকে প্রকাশ্যে ‘চোর’ বা ‘জালিয়াত’ বলতে দ্বিধা করেন। কিন্তু গরিব চাষী, প্রান্তিক গ্রামীণ মানুষ একটা খাটিয়া নিয়ে গেলেই সার্বিক অধঃপতনের চেহারাটা দেখতে পান এঁরা। সমবেত কলরোল ওঠে— খাটিয়া চোর, খাটিয়া চোর, খাটিয়া চোর!

শুধু রাজনীতিকদের কথাই বা কেন বলব? বলিউডি চিত্রনাট্যে খিদের জ্বালায় রুটি চুরি করা নাবালককে কোনও পাষণ্ডের হাতে বেধড়ক মার খেতে দেখে আমাদের মতো যাঁদের দু’চোখ বেয়ে জলের ধারা নামে, তাঁরাও তো এই ‘খাটিয়া চোর’ রবে গলা মিলিয়েছি। দেওরিয়ার ঘটনায় আমরাও তো এক সার্বিক অধঃপতন দেখতে পেয়েছি!

অধঃপতনটা আসলে কাদের? আসুন একটু ভাবি।

Anjan Bandyopadhyay Newsletter
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy