Advertisement
E-Paper

মামেকং শরণম্‌

মহামন্দায় মার্কিন অর্থনীতি নাজেহাল, ফ্র্যাঙ্কলিন রুজভেল্টের নিউ ডিল তখনও ভবিষ্যতের গর্ভে। এমনই এক পরিস্থিতিতে জন্ম হইয়াছিল একটি চরিত্রের— তাহার নাম সুপারম্যান।

শেষ আপডেট: ১৬ জুন ২০১৭ ০০:১৭

মহামন্দায় মার্কিন অর্থনীতি নাজেহাল, ফ্র্যাঙ্কলিন রুজভেল্টের নিউ ডিল তখনও ভবিষ্যতের গর্ভে। এমনই এক পরিস্থিতিতে জন্ম হইয়াছিল একটি চরিত্রের— তাহার নাম সুপারম্যান। যদি এমন হইত, দুনিয়া উদ্ধারের সম্পূর্ণ দায়িত্বটি সুপারম্যান নিজের কাঁধে না লইয়া তাহা বিভিন্ন দফতরের মধ্যে ভাগ করিয়া দিতেন? তবে কি আজও চরিত্রটির এমনই জনপ্রিয়তা থাকিত? উত্তরটি খুলিয়া বলা বাহুল্যমাত্র। ভারতে এখন সুপারম্যানের যুগ চলিতেছে। তিনি এমনই এক নেতা, কোনও সমস্যাই যাঁহার সমাধানের সাধ্যের অতীত নহে, এবং তিনি ব্যতীত আর কাহারও সাধ্য নাই সেই সমাধানে পৌঁছাইবার— এই কথাটি প্রতিষ্ঠা করাই এখন ভারতীয় রাজনীতির কারিগরদের মূল উপজীব্য। এই বিশ্বাসটি কী ভাবে নির্মিত হয়, ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের প্রচারপর্ব তাহার সাক্ষী। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আচরণেও সেই ঘরানার প্রভাব আছে। তবে, তাঁহার একটি নিজস্ব ধর্মও আছে— তিনি যে সমস্যাগুলির সমাধান করিয়া থাকেন, সেগুলি মূলত প্রাত্যহিক। যেমন, গরিব ঘরের ছেলেমেয়েদের উচ্চশিক্ষার খরচ কোথা হইতে আসিবে; হাসপাতালে রোগী ভর্তি করিতে অসুবিধা হইলে কী করণীয়; বিনিয়োগকারীরা লালফিতার ফাঁসে আটকাইয়া গেলে কোথায় যাইবেন— এই প্রশ্নগুলির উত্তর তাঁহার নিকট আছে। এবং, ধরিয়া লইতে হইবে যে শুধু তাঁহারই নিকট আছে, কারণ সচরাচর তিনি সটান তাঁহার দ্বারস্থ হইবার পরামর্শ দিয়া থাকেন। তাঁহার চোখ পড়িলে হাসপাতালের জঞ্জাল সাফ হয়, তিনি বিরক্ত হইলে রাস্তা সারাই হয়। মন্ত্রী, আমলা, করণিক— প্রশাসনের বিভিন্ন ধাপ তবে কী করিতে আছে, এই প্রশ্ন অর্থহীন। সুপারম্যানের নবান্ন থাকে না।

প্রশাসনিকতার এই সংজ্ঞাটি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অবদান নহে। এমনকী, এই রাজ্যেও তিনি পথিকৃৎ নহেন। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যও এই পথে কয়েক কদম হাঁটিয়াছিলেন। জ্যোতি বসু হয়তো ব্যতিক্রম ছিলেন। অবশ্য দুর্জনে বলে, যে কাজগুলি একান্তই তাঁহার কর্তব্য ছিল, তিনি সেই সব ক্ষেত্রেও প্রাজ্ঞ ঔদাসীন্য বজায় রাখিতে পারিতেন। ‘আমি একাই সব সমস্যার সমাধান করিয়া দিব’, মুখ্যমন্ত্রীর এহেন মনোভাব রাজ্যের প্রশাসনিকতার পক্ষে কতখানি ক্ষতিকর, তাহা বাড়াইয়া বলা কঠিন। খুচরা কাজের একটি নিজস্ব আকর্ষণ আছে— তাহার ফাঁদে ধরা দিলে বড় কাজের দিকে নজর ফিরাইবার আর অবকাশ থাকে না। তাহাতে কয়েক জন দরিদ্র ছাত্রছাত্রীর সুবিধা হয় অথবা হাসপাতালের একটি অংশ সাফসুতরা হয় বটে, কিন্তু গোটা রাজ্যের বিপুল ক্ষতি। এই কাজগুলি জরুরি, সন্দেহ নাই, কিন্তু কাজগুলি মুখ্যমন্ত্রীর নহে। তাঁহার জন্য বৃহত্তর কর্তব্য রহিয়াছে।

প্রশাসনিকতা যদি ব্রহ্মাণ্ড হয়, তবে তাহার কেন্দ্রে কী থাকিবে, তাহাই মূল প্রশ্ন। কেন্দ্রে যদি ব্যবস্থা থাকে, প্রতিষ্ঠান থাকে, তবে ব্যক্তির আর ততখানি গুরুত্ব থাকে না। তিনি প্রধানমন্ত্রী বা মুখ্যমন্ত্রী হইলেও নহে। কিন্তু, রাজনীতিতে যেহেতু সুপারম্যান-পর্ব চলিতেছে, অতএব প্রশাসনিকতার ব্রহ্মাণ্ডের কেন্দ্রে প্রতিষ্ঠিত হন ব্যক্তি। প্রসঙ্গত ভগবদ্গীতার শ্রীকৃষ্ণের কথা স্মরণে আসিতে পারে। মতান্তরে, তিনিই ভারতের প্রথম সুপারম্যান। অবশ্য, তিনি আরও এক ধাপ আগাইয়া ছিলেন— ব্রহ্মাণ্ডের কেন্দ্রস্থলে তিনি নহেন, তাঁহার মুখগহ্বরে ব্রহ্মাণ্ডের স্থান। কিন্তু, মহাকাব্য মাথায় থাকুক, আপাতত কঠিন কঠোর সমস্যাসংকুল বর্তমানের প্রতি মনোনিবেশ করা বিধেয়। ব্যক্তি আসিয়া প্রতিষ্ঠানের গুরুত্ব খর্ব করিলে যে দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি হয়, তাহা অপূরণীয়। দরিদ্র ছাত্রের পড়িবার খরচ জোগাড় হউক, কিন্তু তাহার জন্য যেন মুখ্যমন্ত্রীকে বিচলিত না হইতে হয়। তাহাতে জনপ্রিয়তার হয়তো খানিক ক্ষতি হয়, কিন্তু রাজ্যের লাভে সেই ক্ষতি পুষাইয়া বহু উদ্বৃত্ত থাকিবে।

West Bengal CM Mamata Banerjee মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy