Advertisement
০৪ ডিসেম্বর ২০২৪
লড়াই করার স্বাধীনতা

কোনও ভারতীয় ষোড়শী গ্রেটা থুনবার্গ হতে পারে না কেন

স্টকহোমের চেয়ে অনেক বেশি দূষিত শহর আমাদের দেশে অন্তত কয়েক ডজন আছে।

—ফাইল চিত্র।

—ফাইল চিত্র।

অতনু বিশ্বাস
শেষ আপডেট: ১৪ অক্টোবর ২০১৯ ০০:১০
Share: Save:

অনেক ভেবে দেখেছি, আজকের ভারত একটা গ্রেটা থুনবার্গ তৈরি করতে পারে না কিছুতেই। শতাব্দী-লালিত যে সামাজিক-রাজনৈতিক প্রেক্ষিত থাকলে, যে পটভূমিকায় সমাজের মননকে সযত্নে বিকশিত হওয়ার সুযোগ দিলে একটা ১৬ বছরের মেয়ে প্রত্যাসন্ন প্রলয়-সন্ধ্যায় পৃথিবীর তাবড় রাজনীতিকদের মনে করিয়ে দিতে পারে দিনের অন্তিমকালের কথা, রাষ্ট্রনেতাদের সামনে মাথা তুলে অকপটে বলতে পারে, “এত স্পর্ধা হয় কী করে তোমাদের!”, আমাদের মতো দেশে তার অভাব রয়েছে বইকি।

স্টকহোমের চেয়ে অনেক বেশি দূষিত শহর আমাদের দেশে অন্তত কয়েক ডজন আছে। বল্টিক সমুদ্রের চেয়ে বঙ্গোপসাগর বা আরব সাগরের দূষণ নিশ্চয়ই কম নয়। এ দেশে বায়ুদূষণে অফিস, স্কুল ছুটি দিতে হয়, ক্রিকেটাররা মুখোশ পরে মাঠে নামে। এ দেশের ছেলেমেয়েরাও টিভি চ্যানেলে ক্রমশ আরও উষ্ণ-হয়ে-ওঠা এই গ্রহটার পরিবেশের নানা বিপর্যয় সংক্রান্ত ছবি দেখে। কিন্তু দিল্লি, কানপুর বা কলকাতার কোনও ১৫ বছরের মেয়েকে স্কুল স্ট্রাইক করে প্ল্যাকার্ড হাতে দিনের পর দিন পার্লামেন্ট বা বিধানসভার সামনে বসে থাকতে দেখব, এ এক প্রকার অবাস্তব ভাবনা-চিন্তা। মেয়েটি বড় জোর বায়ুদূষণের হাত থেকে বাঁচতে মুখোশে মুখ ঢেকে স্কুল বা কোচিং ক্লাসে দৌড়বে। সামনের বোর্ডের পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য। তার জীবনে এই দু’তিন বছর ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। এ সময়ে অনেকেরই রয়েছে আইআইটি কিংবা নামী ইঞ্জিনিয়ারিং বা মেডিক্যাল কলেজগুলিতে সুযোগ পাওয়ার পরীক্ষার দম-বন্ধ-করা প্রস্তুতি। অথবা ভাল নম্বর নিয়ে স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে তাকে ভর্তি হতে হবে ভাল কলেজে, দামি কোনও বিষয় নিয়ে পড়তে। আমাদের দেশের আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতিতে এই ইঁদুর

দৌড়ে দৌড়নোটাই ১৫-১৬ বছর বয়সের শতাব্দী-সঞ্চিত নিয়তি।

তাই গ্রেটার প্রতিবাদের ধরনটাকে সার্বিক ভাবে আমাদের সমাজ খুব মুক্ত মনে অনুমোদন দেবে না, বলাই বাহুল্য। আমাদের দেশের কোনও ১৫ বছরের মেয়েকে সপ্তাহে এক দিন করে ‘পরিবেশের জন্য’ একক স্কুল স্ট্রাইক শুরু করতে প্রশ্রয় দেবে তার অভিভাবক? তার স্কুল? বা দেশ-বিদেশে পরিবেশ-রক্ষার প্রচারের জন্য স্কুল থেকে এক বছরের বিরতি নেওয়ার সুযোগ করে দেবে? আজ না হয় গ্রেটা এক বিশ্বজোড়া সেলেব্রিটি। পুরস্কারে পুরস্কারে ভেসে যাচ্ছে তার বায়োডেটা। কিন্তু এক বছর আগের সুইডেনের পার্লামেন্টের সামনে তার একক প্রতিবাদের দিনগুলি তো তেমন ছিল না। তার একক স্ট্রাইকে গুটিকতক সঙ্গী জুটতেও সময় লেগেছে। তার আগে দিনের পর দিন একা মেয়েটা প্ল্যাকার্ড হাতে বসে থাকে রিক্‌স্‌ড্যাগ বা সুইডিশ পার্লামেন্টের সামনে। সেই প্রতিবাদ ক্রমে সঙ্গী পেয়েছে। প্রথমে দু’দশ জন। পরে লক্ষ লক্ষ। এ গ্রহের দিকে দিকে। দেশে দেশে। অবশ্য ফি-শুক্কুরবার গ্রেটার এই স্কুল স্ট্রাইকের ব্যাপারটাকে সবাই যে খুব ভাল চোখে দেখেছে তেমনটাও নয়। ইউরোপেরই নানা স্কুল তার ছাত্রদের পরিবেশের জন্যে স্ট্রাইক করতে দিতে চায়নি। তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টেরেসা মে-র অফিস দেশে-বিদেশে পরিবেশের নামে এই স্কুল স্ট্রাইককে বলেছে ‘পড়ার সময় নষ্ট’। অস্ট্রেলিয়ার এক শিক্ষামন্ত্রী ১৫ মার্চের ইস্কুল স্ট্রাইক করা ছাত্রদের শাস্তির হুমকি দিয়েছেন। এই মানসিকতারই উত্তরাধিকার নাড়িতে বয়ে নিয়ে চলেছি আমি আপনি— এ কথা স্বীকার করতে কোনও দ্বিধা নেই।

আচ্ছা, তর্কের খাতিরে না হয় ধরে নেওয়া গেল যে, আমাদের দেশেও এমনই কোনও ষোড়শী স্কুল স্ট্রাইক করে প্ল্যাকার্ড নিয়ে নামছে এক একক আন্দোলনে। এমনই কোনও বৃহত্তর অভীক্ষায়। কিন্তু আমাদের দেশের ব্যবস্থাদি, আইনশৃঙ্খলা, নিরাপত্তার বেষ্টনী, সামাজিক প্রেক্ষিত তাকে কি সংসদ মার্গে পার্লামেন্টের সামনে, বা কোনও রাজ্য বিধানসভার সামনেও দিনের পর দিন একক হরতাল করতে দেবে এ ভাবে? গ্রেটার প্রতিবাদ-আন্দোলন কি আদৌ এ ভাবে শুরু হতে পারত আমাদের মতো দেশে? আবার, এটাও তো ঠিক যে, সার্বিক ভাবে জলবায়ুর মতো জটিল বিষয়ে যুগান্তের জমে ওঠা বিপর্যয়ের দায় আজকের পৃথিবীর সকল রাজনীতিকদের ঘাড়ে চাপানোও বড় সহজ কথা নয়।

তবু এটা মানতেই হবে, গ্রেটা থুনবার্গও কিন্তু তৈরিই হয়। তৈরি করে পরিবার, সমাজ, দেশ, দুনিয়া, এমনকি সময়ও। অ্যাসপার্গার্স সিন্ড্রোম, অ্যাটেনশন ডেফিসিট হাইপারঅ্যাক্টিভিটি ডিজ়অর্ডার, অবসেসিভ-কম্পালসিভ ডিজ়অর্ডার, সিলেক্টিভ মিউটিজ়ম-এর মতো অসুখে আক্রান্ত ১৫-১৬ বছর বয়সি একটা স্কুলের মেয়ের বদলে-চলা পরিবেশ আর তার বিপর্যয় নিয়ে ভয় আর অবসাদকে এক দৃঢ়তা, সঙ্কল্প আর সংগ্রামের গল্পে পাল্টে ফেলতে অবশ্যই চাই অনুকূল সামাজিক এবং পারিবারিক পরিবেশ। পরিবারের কাছ থেকে প্রশ্রয় এবং পরিবেশ-সচেতন মানসিকতার সযত্ন উত্তরাধিকারও পেয়েছে গ্রেটা। তার মা, মেলেনা এর্নম্যান শুধুমাত্র সুইডেনের এক নামী অপেরা গায়িকাই নন, জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে প্যারিস চুক্তির সমর্থনে রাজনৈতিক ভাবে যথেষ্ট সক্রিয়। ২০১৭-তে ডব্লুডব্লুএফ-সুইডেন-এর ‘এনভায়রনমেন্টাল হিরো অব দ্য ইয়ার’ পুরস্কারও পেয়েছেন মেলেনা। এই উত্তরাধিকার এবং তাঁর ছত্রচ্ছায়া নিঃসন্দেহে এগিয়ে দিয়েছে গ্রেটাকে। নইলে একটা ক্লাস নাইনের মেয়ে হাতে প্ল্যাকার্ড নিয়ে তাতে (সুইডিশ ভাষায়) ‘পরিবেশের জন্য স্কুল স্ট্রাইক’ লিখে দেশের সংসদের সামনে একা বসে পড়ল, সে বড় সহজ কথা নয়। স্বাভাবিক তো নয়ই। এটা মনে রাখতে হবে, গ্রেটার সঙ্গে সঙ্গে প্লেনে চড়া ছেড়েছেন তার বাবা-মাও। তবে এটাও ঠিক যে, প্রথম থেকেই সুইডিশ এবং আন্তর্জাতিক মিডিয়ার অভাবনীয় দাক্ষিণ্য পেয়েছে গ্রেটা। তা সে যে কারণেই হোক না কেন।

তবে, ইতিমধ্যে মানসিকতায় আমাদের সমাজও এগিয়েছে অনেকটাই। স্কুল কেটে গানের সাধনা, ব্যাডমিন্টন বা কুস্তিতে বিশ্ব-চ্যাম্পিয়ন হওয়ার সাধনাতে প্রশ্রয় দিতে অনেকটাই শিখে ফেলেছে আমাদের এই সমাজ। সেটাও সমাজের মানসিকতার এক ধরনের বিবর্তন নিশ্চয়ই। তবে সেগুলি হল প্রতিভার উৎকর্ষের চর্চা। হ্যাঁ, আমাদের দেশের ছেলেমেয়েরাও অবশ্যই বিশ্ব জয় করতে পারে। তাদের প্রতিভায়, নিষ্ঠায়, অনুশীলনে। তারা বিশ্বনাথন আনন্দ হতে পারবে, সচিন তেন্ডুলকর হতে পারবে, পিভি সিন্ধু হতে পারবে। কলা, শিল্প কিংবা বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে তাদের প্রতিভায় আর সাধনায় মুগ্ধ করতে পারবে দুনিয়াকে। কিন্তু এক অনাবিল ভয় এবং প্রতিস্পর্ধায় রাষ্ট্রপুঞ্জে দাঁড়িয়ে হয়তো বলতে শিখবে না, ‘‘হাউ ডেয়ার ইউ!’’

গ্রেটা থুনবার্গ আসলে নির্দিষ্ট এক সময়কালের সন্তান। পৃথিবীর ক্রমবর্ধমান উষ্ণায়ন, উত্তর সমুদ্রের গলতে থাকা হিমবাহ, পরিবেশের মাত্রাতিরিক্ত দূষণ, আর তার মধ্যেই ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্যারিস চুক্তি থেকে সরে যাওয়া— সমস্তটাই এ গ্রহের ইতিহাসের এক ক্রান্তিকাল। এক দিকে বায়ুদূষণে ধুঁকতে থাকা শত শত শহর-নগর, আর অন্য দিকে অতলান্তিকের ও-পারে আর এক তরুণী, আলেকজ়ান্দ্রিয়া ওকাসিয়ো-কর্তেজ় ‘সবুজ নতুন স্বপ্ন’ (গ্রিন নিউ ডিল) দেখাতে ব্যগ্র। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও প্রেক্ষিতটা তাই তৈরি হয়েই ছিল। তার মাঝেই এক ১৬ বছরের সুইডিশ মেয়ে ‘ভয়’ পেয়েছে— মর্তলোকে মহাকালের নতুন খাতার পাতা জুড়ে একটা শূন্য নামবে। সে বেরিয়েছে সেই ‘ভয়’কে ফেরি করতে, বিশ্ব জুড়ে।

এক অবসাদগ্রস্ত কিশোরীর আবেগকে কাজে লাগিয়ে স্বার্থসিদ্ধির জন্য তাকে এই প্রচারের মুখ হিসেবে গড়ে তোলা হয়েছে কি না, সে প্রশ্নও উঠছে বার বার। তবু, তার চলার পথে অ্যাসপার্গার্স সিন্ড্রোম, অ্যাটেনশন ডেফিসিট হাইপারঅ্যাক্টিভিটি ডিজ়অর্ডারের মতো অসুখ প্রতিবন্ধ না হয়ে উল্টে হয়ে ওঠে এক মহাশক্তির আধার। তার সমস্ত অবসাদ, পরিবেশ এবং জলবায়ু নিয়ে যাবতীয় ভয়কে ছাপিয়ে নিজেই ব্যাপ্ত হয়ে ওঠে গ্রেটা। হয়ে ওঠে যেন ট্রয়ের ধ্বংসের পূর্বাভাস করা ক্যাসান্দ্রার আধুনিক সংস্করণ। তবু গ্রেটা থুনবার্গ যেন একান্তই এক দূর দেশের মেয়ে। এক ভিন্গ্রহের প্রাণী। অস্পষ্ট। অচেনা। কিছুতেই যেন তাকে চিনতে পারি না, মেলাতে পারি না ‘আমাদের মেয়ে’ বলে।

ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউট, কলকাতা মতামত ব্যক্তিগত

অন্য বিষয়গুলি:

Greta Thunberg Climate Change Pollution
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy