মোহনবাগানের অনূর্ধ্ব-১৪ দলে ট্রায়াল দিতে কলকাতায় এসেছিলেন মেদিনীপুর সদর ব্লকের চাঁদরা এলাকার পিন্টু মাহাতো। অনূর্ধ্ব-১৪ মোহনবাগানের কোচ অমিয় ঘোষ জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘‘ট্রায়ালের সময়ে কোথায় থাকবে?’’ পিন্টু জানিয়েছিলেন, হাওড়া স্টেশনে রাত কাটিয়ে সকালে ঠিক সময়ে মাঠে চলে আসবেন। নিজের বাড়িতেই পিন্টুকে নিয়ে গিয়েছিলেন কোচ। টানা তিন বছর রেখেছিলেন নিজের কাছে। পিন্টু এখন মোহনবাগানের প্রথম একাদশের নিয়মিত সদস্য।
মোহনবাগান মেসে থাকেন পিন্টু। কিন্তু প্রতিভা থাকলেও থাকার জায়গা না পেয়ে হারিয়ে গিয়েছেন জেলার অনেক ফুটবলার। খেলার সুযোগ পেয়েছেন। কিন্তু রাতে থাকার জায়গা নেই। ফলে মাঝে মধ্যেই কেটে যাচ্ছে জেলা থেকে কলকাতা মাঠে ফুটবলারদের ‘সাপ্লাই লাইন’। পথের ধকলে অনেকে হারিয়ে যাচ্ছেন।
কলকাতা ময়দানে মেসবাড়ির ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। ষাট ও সত্তরের দশকে মোহনবাগান, মহমেডান মেসে বহু নামী ফুটবলার থাকতেন। সুব্রত ভট্টাচার্য, মহম্মদ হাবিবের মতো ফুটবলাররাও। জেলার ফুটবলারদের থাকার জায়গাও ছিল মেস। অনেক ছোট ক্লাবেরও মেস ছিল। কিন্তু নব্বইয়ের শুরু থেকে মেসগুলো বন্ধ হতে শুরু করে। এখনও মোহনবাগানের মেস রয়েছে। পশ্চিম মেদিনীপুরের প্রত্যন্ত গ্রামের ছেলে পিন্টু মাহাতো-সহ কয়েকজন থাকেন। তবে সংখ্যাটা হাতেগোনা। বড় দলগুলির বেশিরভাগ ফুটবলার দামী ফ্ল্যাটে থাকেন। ছোট দলগুলো মেস তৈরির কথা ভাবেনি।
হলদিয়ার একঝাঁক ফুটবলার একসময়ে কলকাতা ময়দানে নিয়মিত খেলতেন। মহমেডান স্পোর্টিংয়ে খেলতেন শেখ আব্দুল কাদের, বেহালা ইউথে খেলতেন রসময় দাস অধিকারী। তাঁদের আক্ষেপ, সেই সময়ে জেলার ছেলেদের কলকাতা ময়দানে যে সমস্যায় পড়তে হত, এখনও সেগুলি রয়ে গিয়েছে। রসময়বাবু বলেন, ‘‘হলদিয়া থেকে কলকাতা ময়দানে সুযোগ পাওয়া ফুটবলারদের একদম সকালে অনুশীলনে যেতে হয়। সে জন্য অনেকেই রাত সাড়ে ১২টার বাস ধরে মেচেদা স্টেশনে যান। তার পর ট্রেন ধরে ভোর রাতে হাওড়ার পৌঁছন। অনুশীলন শেষ হলে একই ভাবে ট্রেন ও বাসে করে বাড়ি ফিরে আসা। এই ভাবে বেশিদিন চালানো সম্ভব নয়। তাই অনেকে মাঝপথেই কলকাতার ক্লাবে অনুশীলন করা বন্ধ করে দেয়।’’ রাজস্থানের প্রাক্তন ফুটবলার পুলক মজুমদার জানান, মেদিনীপুর থেকে অনেক সম্ভবনাময় ফুটবলার বিভিন্ন সময়ে কলকাতা ময়দানে গিয়েছেন। কিন্তু থাকার জায়গার অভাবে টিকতে পারেননি। পুলকের দাদা অলোক ইস্টার্ন রেলের অধিনায়ক ছিলেন। অলোক এর নেতৃত্বে সন্তোষ ট্রফি চ্যাম্পিয়ন হয় রেল।
শালবনির আসমানচকের বাসিন্দা রঞ্জিত মান্ডি হাওড়া ইউনিয়ন ও সাদার্ন ক্লাবে সুযোগ পেয়েছিলেন। কলকাতায় নিজের খরচে থাকা খাওয়া চালিয়ে ফুটবল খেলা সম্ভব হয়নি। তাই ছেড়ে চলে এসেছেন। শালবনি গাইঘাটার মেঘনাথ হেমব্রম ঐক্য সম্মেলনীতে খেলার সুযোগ পেয়েছিলেন। কলকাতায় থাকার সমস্যায় পড়েন। মাঝে মধ্যেই অনুশীলন বন্ধ হত। তাই গ্রামে ফিরে এসেছেন। মহিষাদলের সঞ্জীব চৌধুরী টালিগঞ্জয়ের গোলরক্ষক ছিলেন। বর্তমানে ময়দানের নামী রেফারি। মহিষাদলের সঞ্জয় বন্দ্যোপাধ্যায় কলকাতার প্রথম ডিভিশনে বিভিন্ন দলের গোলরক্ষক ছিলেন। দীর্ঘদিন কোচিং করিয়েছেন কলকাতার নামী দলে। মহিষাদলের সাইফুর রহমান, সুব্রত আচার্য, তমলুকের কৃপাসিন্ধু মাইতি, জয়দেব করণ, ময়নার গোপাল মরদানয়, চণ্ডীপুরের পীযূষ গিরি, মোহনবাগানে খেলে যাওয়া সুযশ বেরা ও হলদিয়ার বাসুদেব পাত্রর মতো খেলোয়াড় জেলা থেকেই গিয়েছিলেন। সাপ্লাই লাইন ছিল এই মেদিনীপুর। এ ভাবেই তালতলা, মোহনবাগান, মহমেডান স্পোর্টিং, ক্যালকাটা জিমখানা-সহ বিভিন্ন ক্লাবে খেলা জেলার ছেলেদের স্বপ্ন এক এক করে শেষ হয়ে গিয়েছে। এই প্রাক্তনীদের সকলের কাজ জোটেনি। হলদিয়ার প্রতিবন্ধী খেলোয়াড় বনমালী হাজরা, মহমেডান স্পোর্টিংয়ের খেলা ব্রজলালচকের শেখ কাদের আলির আর্থিক অবস্থা ভাল নয়। কাদের ট্রান্সপোর্ট সংস্থার সঙ্গে যুক্ত। বনমালী টোটো চালান।
তালতলার প্রাক্তন খেলোয়াড় মঞ্চলাল দে জানান, মেয়েরা আরও সমস্যায় পড়ছেন। তাঁর কথায়, ‘‘জাতীয় পর্যায়ে মহিলা ফুটবলে হলদিয়া সাপ্লাই লাইন। দুর্গাচকের মিলন সঙ্ঘের ৯ জন মহিলা ফুটবলার এবার জাতীয় ফুটবলে অংশ নিচ্ছেন। মহিলা ফুটবলার নীলাঞ্জনা দে, মামণি জানা, মিলি হাঁসদা, মৌসুমি গুহর মতো সাতজন মহিলা ফুটবলার কলকাতায় খেলছেন।’’ প্রাক্তন ফুটবলার এবং জেলা ফুটবলের কর্মকর্তা সঞ্জয় বন্দ্যোপাধ্যায় জানান, একসময় বেহালাতে থাকার জায়গা ছিল। সেখানে জেলার বেশ কিছু ছেলে মেয়ে থাকতেন। খেলোয়াড়দের জন্য থাকার জায়গার দাবি সঙ্গত। তাঁর কাছে বহু সময়ে বিভিন্ন উঠতি খেলোয়াড়, অ্যাথলিটরা আসেন থাকার সমস্যা নিয়ে।
বর্তমান প্রজন্মের ছেলে মেয়েদের কলকাতার ময়দানে নিয়ে যাওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করছেন হলদিয়ার প্রাক্তন ফুটবলাররা। তাঁরা প্রাক্তন ফুটবলারদের সংগঠন গড়ে শুরু করেছেন হলদিয়া লিগ। লিগের খেলায় প্রতিভা খোঁজেন তাঁরা। এই প্রাক্তনীদের মধ্যে পুলক মজুমদার, তালতলার মঞ্চলাল দে, বেহালা ইউথের রসময় দাস অধিকারী, মহমেডান স্পোর্টিংয়ের শেখ আবদুল কাদের রয়েছেন। এখনও তাঁরা ছুটির দিনে ময়দানে নামেন বল নিয়ে। প্রাক্তন ফুটবলারদের সংগঠনের সম্পাদক রসময় দাস বলেন, ‘‘আমাদের সময়ে ফুটবলের যে জোয়ার ছিল সেই জোয়ার ফিরিয়ে দিতে চাই। তাই লিগ শুরু করেছি। অনেক তরুণ ময়দানে খেলছেন। কলকাতার তিন প্রধানের জুনিয়র দলে, টাটা ফুটবল অ্যাকাডেমি-সহ নানা ক্লাবে ছেলে মেয়েরা খেলছে। কিন্তু আমাদের সময়ের সমস্যা আজও যায়নি।’’ সংগঠনের সভাপতি ধর্মধ্বজ ভুঁইয়া বলেন, ‘‘আমাদের সময়ে যে সমস্যার মুখোমুখি হয়েছি তা এখনও ছেলে মেয়েরা করছে। এর একটা ব্যবস্থা চাই।
মহিষাদলেও খেলাধুলোর চর্চা বেড়েছে। রাজ স্কুল ময়দানে কোচ বিপ্লব চক্রবর্তীর উদ্যোগে ফুটবল ও ক্রিকেটে চর্চা চলছে। পূর্ব মেদিনীপুরের ক্রীড়া মহলের দাবি, জেলায় খেলা আবার ভাল ভাবে হচ্ছে। কলকাতার আশেপাশে তৈরি হোক খেলোয়াড়দের মেস। হলদিয়ার শিল্প সংস্থাগুলো উদ্যোগী হলে কাজটি দ্রুত হবে, মত প্রাক্তনীদের।
মেদিনীপুর জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক বিনয় দাসমাল বলেন, ‘‘যে ক্লাবের হয়ে জেলার ছেলেরা খেলবে সেই ক্লাবেরই থাকার ব্যবস্থা করা উচিত। বড় ক্লাবগুলোতে তাই হয়।’’ তাঁর কথায়, ‘‘জেলার ছেলেরা কলকাতায় গিয়ে অন্য ক্লাবের হয়ে খেলবে। এতে জেলা ক্রীড়া সংস্থার লাভ হবে না। তাই এরকম পরিকল্পনা এখন পর্যন্ত নেই।’’
সহ প্রতিবেদন সৌমেশ্বর মণ্ডল