প্রতিবাদ। সিরিয়ার কোবানে শহর মুক্ত করার দাবিতে। ব্রাসেলস, নভেম্বর। ছবি: এএফপি।
উত্তর কেনিয়ায় শিক্ষক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের একটি দল নাইরোবি-গামী বাসে চড়ে যাচ্ছিলেন। ভোরবেলা সোমালিয়ার আল-শাবাব গোষ্ঠীর জঙ্গিরা তাঁদের ২৮ জনকে হত্যা করল। একই দিনে আফগানিস্তানের পাকতিকা প্রদেশে ভলিবল ম্যাচ দেখতে জড়ো হওয়া ক্রীড়ামোদীদের জমায়েতে সশস্ত্র হামলা চালিয়ে তালিবান জঙ্গিরা ৪৫ জন দর্শককে মেরে ফেলল। ইতিমধ্যে এক দিন নাইজিরিয়ায় ‘বোকো হারাম’ জেহাদিরা ৪৮ জনকে দাঁড় করিয়ে গলার নলি কেটে খুন করল, পর দিন মসজিদে বোমা মেরে ৬৮জনকে। পাকিস্তানের ওয়াগা সীমান্তে আত্মঘাতী হামলায় ৬০ জন নিহত হলেন। আর সিরিয়া ও ইরাকে তো নিত্যদিন জঙ্গিরা শিয়া, ইয়াজিদি, কুর্দ প্রভৃতি জনগোষ্ঠীকে হত্যা করছে। তাদের শিশু ও মহিলাদের অপহরণ করছে, মহিলাদের যৌনদাসী হিসাবে যোদ্ধাদের মধ্যে বিলিয়ে দেওয়া হচ্ছে, এক-এক রাতে এক-এক যোদ্ধার কিংবা একই রাতে একাধিক যোদ্ধার শয্যাসঙ্গিনী হতে। এবং এ সমস্তই ঘটছে, ঘটানো হচ্ছে ইসলামের নামে, শুদ্ধ আদি ইসলামে ফিরে যাওয়ার আন্দোলনের অংশ হিসাবে। এই যদি শুদ্ধ ইসলাম হয়, তবে মানবসভ্যতার ক্ষয়িষ্ণু বর্বরতা কাকে বলে?
মতাদর্শগত ভাবে এই সব জেহাদি গোষ্ঠী ওয়াহাবি ও সালাফি ইসলামের অভিভাবকত্ব ও পৃষ্ঠপোষণা শিরোধার্য করে। মধ্যযুগীয় ইসলামি পণ্ডিত ইবন হানবল ও ইবন তাইমিয়া-র রচনায় নবির সমকালীন ও পরবর্তী তিন প্রজন্মের পূর্বপুরুষদের ধর্মাচরণের পথে প্রত্যাবর্তনের যে অনুজ্ঞা আছে, সালাফিয়ানার বৈশিষ্ট্য সেটাই। তদনুযায়ী অষ্টাদশ শতকে মহম্মদ ইবন আবদুল ওয়াহাব যখন তাঁর কট্টরপন্থা নিয়ে হাজির হলেন ইবন সৌদ-এর সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে, তখনই অটোমান খলিফার মুসলিম রাজশক্তির সঙ্গে দ্বন্দ্ব বাধে। বেকতাসি, কাদিরিয়া প্রভৃতি সুফি তরিকার উদার ধর্মে দীক্ষিত অটোমান তুর্কিরা স্বভাবতই ওয়াহাবি চ্যালেঞ্জের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান এবং তাদের বিতাড়িত করেন আরবের প্রত্যন্ত মরু অঞ্চলে। দরিদ্র বেদুইন জনজাতিগুলিকে নিয়ন্ত্রণ করে ওয়াহাবিরা সৌদি রাজবংশের সঙ্গে গড়ে তোলে তাদের গোঁড়া ধর্মতত্ত্বের ইমারত। সেই থেকে সৌদি পেট্রোডলারেই দিকে-দিকে ছড়িয়ে পড়ছে ওয়াহাবি সুন্নি আধিপত্যের জঙ্গি রূপ। নাইজেরিয়ার বোকো হারাম এমনই এক ওয়াহাবি-সালাফি গোষ্ঠী, যার প্রতিষ্ঠাতা মহম্মদ ইউসুফ ২০০৯ সালে বলেছিলেন, ‘বোকো হারাম মানে ‘পশ্চিমী শিক্ষা নিষিদ্ধ’, কারণ এই শিক্ষা এক আল্লাহ্য় বিশ্বাস নষ্ট করে দেয়। বলে বৃষ্টি নাকি সূর্যতাপে জলের বাষ্প হয়ে ঘনীভূত হওয়ার ফল, অথচ আমরা জানি বৃষ্টি আল্লাহ্র সৃষ্টি। আমরা ডারউইনের মতবাদও মানি না, কেননা তা আল্লাহ্র শিক্ষার পরিপন্থী।’ তালিবানরা নারী-স্বাধীনতা সম্পর্কে কী মত পোষণ করে, তা সর্বজনবিদিত। সিরিয়া ও ইরাকে ইসলামি রাষ্ট্রবাদীরা তাদের দখলীকৃত জনপদগুলিতে যে শাসন চালু করেছে, তা-ও সংকীর্ণতায় ভরা। সেখানে মেয়েদের ক্লিটরিস কেটে দেওয়া থেকে শুরু করে পরকীয়ার দায়ে পাথর ছুড়ে হত্যার বিধানও কার্যকর হচ্ছে। চলেছে শিয়া, ইয়াজিদি ও কুর্দদের সুন্নি হওয়ার, নচেৎ নির্মূল করার অভিযান।
ওয়াহাবি প্ররোচনাতেই ১৯২০-র দশকে সৌদি রাজপরিবার মদিনার ১৪০০ বছরের প্রাচীন জন্নৎ-উল-বাকি-র সমাধিক্ষেত্র ধ্বংস করেছিল। এই ঘৃণামিশ্রিত বিদ্বেষই তালিবানকে বৌদ্ধ মূর্তি ও স্মারক ধ্বংস করতে ও ইসলামি রাষ্ট্রবাদীদের দ্বারা ক্রমাগত ঐতিহ্যপূর্ণ শিয়া ধর্মস্থান বোমায়, কামানের গোলায় উড়িয়ে দিতে উৎসাহিত করে চলেছে। বোকো হারাম কিংবা আল-শাবাব এখনও আলাদা করে শিয়াদের ওপর চড়াও হয়নি। তবে খ্রিস্টানদের যেখানে পারছে, মারছে। তবে গোঁড়া সুন্নি এই সব গোষ্ঠীর সবচেয়ে বেশি রাগ শিয়া, সুফি, আহমদিয়া, ইয়াজিদিদের উপর, যারা ওয়াহাবি-সালাফি মতে ‘যথেষ্ট মুসলমান’ নয়। সৌদি আরবের উলেমাতন্ত্রকে এখনও ওয়াহাবের বংশধররাই কঠোর ভাবে নিয়ন্ত্রণ করে, আর সেখান থেকে এবং কাতার থেকে অর্থ বিলি হচ্ছে দেশে-দেশে ওয়াহাবি-সালাফি মতের অনুগামী গড়ার মাদ্রাসা-মক্তব তৈরি করতে।
শুদ্ধ ইসলামে ফেরার নামে বিশ্ব জুড়ে চলছে এই অনাচার আর বর্বরতা। এত যুদ্ধ, অস্ত্রশস্ত্রের ঝঙ্কার, গোলাবারুদের ধোঁয়ায় ইসলামের ভুবন ভরে উঠেছে, যেন ইসলামের সাম্রাজ্যিক বিস্তারের আদি যুগই ফিরে এসেছে। অথচ বাস্তবে যা ঘটছে, তার প্রায় সবটাই বিধর্মীকে স্বধর্মে টানার, দারুল হারাবকে দারুল ইসলামে রূপান্তরিত করার অভিযান নয়, স্বধর্মেরই ভিন্ন গোষ্ঠীকে নিশ্চিহ্ন করার ভ্রাতৃঘাতী রক্তপাত। সশস্ত্র, প্রায়শ মুখোশের আড়ালে আবৃত এই যোদ্ধারা নিজেদের ‘ইসলামের যোদ্ধা’ বলে দাবি করছে, জেহাদি বলছে। কিন্তু এখন, দেড়শো কোটির বেশি মুসলিম জনসংখ্যার এই বিশ্বে ইসলাম যখন একটি প্রতিষ্ঠিত ধর্ম, তখন এমন তরবারির জেহাদের প্রয়োজন কী? জেহাদ তো ধর্মযুদ্ধ। শিয়াদের হত্যা করে গোঁড়া সুন্নিরা কোন ধর্ম প্রতিষ্ঠা করতে চায়? বোকো হারাম, তালিবান কিংবা আল-শাবাব তো নিজেরা সুন্নি হয়েও সুন্নিদেরই হত্যা করছে। এই যুদ্ধ, হত্যা, সন্ত্রাস, অবিরাম রক্তক্ষয় ইসলামকে শুধু কলঙ্কিত করছে না, বিশ্বের অন্য সব ধর্মাবলম্বী এবং ধর্মনিরপেক্ষ ব্যক্তিদের কাছে শান্তি ও আত্মনিবেদনের ধর্ম ইসলাম হয়ে উঠছে হিংসা ও সন্ত্রাসের আর এক নাম। আর সে জন্য এই উগ্র, সংকীর্ণমনা, গোঁড়া ওয়াহাবি-সালাফিরাই তো দায়ী। সন্ত্রাস ও হিংসাখচিত, তীব্র অসহিষ্ণুতাবিড়ম্বিত এমন একটি ধর্মের প্রতি বিধর্মীরা আকৃষ্ট হবে কেমন করে?
দেওবন্দের দারুল উলুম, মুসলিম পার্সোনাল ল’ বোর্ড এবং কেরলের বেশ কিছু মুসলিম ধর্মীয় সংগঠন এই ওয়াহাবি-সালাফি অভিযানের বিরোধিতা করেছেন। আল-কায়দার শীর্ষ নেতা আয়মান আল জোয়াহিরি-র আহ্বান উপেক্ষা করে ভারতীয় মুসলিমদের তাঁরা কাল্পনিক জেহাদের পথে না গিয়ে নিষ্ঠাবান মুসলমানের ধর্মাচরণে সীমাবদ্ধ থাকতে অনুরোধ করেছেন। কিন্তু তার পরেও ইন্ডিয়ান মুজাহিদিন, জামাতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশ, লস্কর-এ-তইবার মতো জেহাদি জঙ্গি গোষ্ঠী ভারতে নাশকতায় লিপ্ত। বেশ কিছু মুসলিম যুবক নানা প্রদেশ থেকে ইরাক পাড়ি দিয়েছে ‘মুজাহিদ’ হওয়ার আশায়, স্বঘোষিত খলিফা আবু বরকত আল-বাগদাদির আহ্বানে শহিদ হয়ে আল্লাহ্ প্রতিশ্রুত জন্নত লাভের আশায়। ইতিমধ্যেই তাদের কেউ কেউ নিহত, মোহমুক্ত কেউ বা দেশে ফিরে আসতে চায়। ভারতের কোটি কোটি মুসলিম জনতার ইরাক, সিরিয়া, নাইজিরিয়া, কেনিয়া, আফগানিস্তানে চলতে থাকা ‘জেহাদ’ নিয়ে কোনও আগ্রহ নেই। তাঁরা ভারতকেই দারুল ইসলাম গণ্য করেন, কারণ এই ভারতের মাটির নীচেই তাঁদের পূর্বপুরুষদের হাড় পোঁতা আছে। এটাই তাঁদের কাছে পুণ্যভূমি। মক্কায় হজযাত্রী হওয়ার বাসনা পোষণ করলেও সকল ভারতীয় মুসলমান তাঁদের দারিদ্র, বঞ্চনা ও অসহায়তার দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকত্বেই ফিরে আসতে উন্মুখ। হিন্দুত্ববাদীরা এটা মনে রাখলে ভাল করবেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy