Advertisement
১৬ এপ্রিল ২০২৪
সম্পাদকীয় ১

আত্মরক্ষণের আত্মঘাত

অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির উপাচার্যের কথার মূল্য তাঁহার পদগুণেই যথেষ্ট। তদুপরি তিনি যদি অত্যন্ত কঠোর শব্দরঞ্জিত কোনও বার্তা দেন, তবে তো তাহা গুরুতর বলিয়াই মানিতে হইবে। সদ্য-নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত বিজ্ঞানী জন ও’কিফ-এর সহিত গলা মিলাইয়া তিনি সম্প্রতি ব্রিটিশ রাষ্ট্রের ভিসা-নীতির তীব্র সমালোচনা করিয়াছেন, যে নীতির বলে আপাতত বিদেশি ছাত্রছাত্রীর পক্ষে ব্রিটেনে পড়াশোনা করিতে আসা মাথায় উঠিবার জোগাড়।

শেষ আপডেট: ১১ অক্টোবর ২০১৪ ০০:০৫
Share: Save:

অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির উপাচার্যের কথার মূল্য তাঁহার পদগুণেই যথেষ্ট। তদুপরি তিনি যদি অত্যন্ত কঠোর শব্দরঞ্জিত কোনও বার্তা দেন, তবে তো তাহা গুরুতর বলিয়াই মানিতে হইবে। সদ্য-নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত বিজ্ঞানী জন ও’কিফ-এর সহিত গলা মিলাইয়া তিনি সম্প্রতি ব্রিটিশ রাষ্ট্রের ভিসা-নীতির তীব্র সমালোচনা করিয়াছেন, যে নীতির বলে আপাতত বিদেশি ছাত্রছাত্রীর পক্ষে ব্রিটেনে পড়াশোনা করিতে আসা মাথায় উঠিবার জোগাড়। ভিসার ফাঁসটি সচেতন ভাবেই এতখানি বজ্রকঠিন করা হইয়াছে যাহাতে ছাত্রসমাজের পক্ষে সে দেশের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন কিংবা গবেষণার সুযোগ লাভ রীতিমত কাঁটাতারের বেড়া পারাইবার শামিল হইয়া দাঁড়াইয়াছে। বিষয়টির ভালমন্দ লইয়া আলোচনার আগে বলা দরকার যে, ইহা একটি বড় পরিবর্তন। সে দেশের বড় ও নামী বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে অভিবাসী ছাত্রসম্প্রদায়ের উপস্থিতি সর্বদাই অতি প্রত্যক্ষ ও সংখ্যাসমৃদ্ধ। গবেষণা ও অধ্যাপনার সুযোগ্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করিয়া এশিয়া ইউরোপ আমেরিকার বিভিন্ন দেশ হইতে উচ্চতর শিক্ষার্থে আগত এই উচ্চশিক্ষিত অভিবাসী সম্প্রদায় ব্রিটিশ বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকেও বিরাট সুনাম আনিয়া দিয়াছেন। এ দিকে, শিক্ষা-বাজারের স্বাভাবিক নিয়মে ব্রিটিশ উচ্চশিক্ষার্থীদের মধ্যেও এক বড় সংখ্যক ছাত্রছাত্রী চলিয়া যাইতেছেন প্রযুক্তি-ভিত্তিক পড়াশোনার ক্ষেত্রে, কিংবা মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়-বলয়ের অভিমুখে। সুতরাং সারস্বত বিদ্যাচর্চায় এখন অক্সফোর্ড-কেমব্রিজেও মেধার বিশেষ অভাব। স্বাভাবিক ভাবেই উপাচার্য মহাশয় প্রশ্ন তুলিয়াছেন যে, মেধা-আমদানি আটকাইবার এই আত্মঘাতী নীতিতে লাভটা কী হইতেছে? অন্যান্য দেশের উচ্চশিক্ষার্থীদের বিমুখ করিবার সঙ্গে সঙ্গে ব্রিটিশ উচ্চশিক্ষাঙ্গনেরও ইহার ফলে বিপুল ক্ষতি সাধন হইতেছে না কি?

কান পাতিলে একই আক্ষেপ শোনা যায় ভারতের ব্যবসায়িক সমাজেও। সেখানেও দক্ষতার মুক্ত চলাচলের পথে পর্বতসমান বাধা তৈরি করিতেছে সরকারি অভিবাসন নীতি। এমনকী পরিষেবা, বিপণন কিংবা পরিকাঠামো-সংক্রান্ত ছোটখাটো চাকরির যে বিরাট ক্ষেত্র বর্ধিষ্ণু দেশের সম্পদ, অভিবাসী কর্মীর অভাব সেখানেও তীব্র ভাবে অনুভূত। সাধারণত অ-কৃষ্ণকায় অ্যাংলো-স্যাক্সন এই সব স্বল্পবেতন কাজে উৎসাহী নন, তাই এই অভাব সহজে ঘুচিবারও নয়। অন্যান্য বহু দেশের তুলনায় ব্রিটিশ সাধারণ্য পরিশ্রমবিমুখ বলিয়া পরিচিত, তাঁহাদের সামাজিক-অর্থনৈতিক প্রত্যাশার হ্যাপাও বড় বেশি। কম খরচে সুলভ, শ্রমোৎসাহী, নির্ঝঞ্ঝাট কর্মীর জন্য আজও বিলেতে অভিবাসী সম্প্রদায়ই বড় ভরসা। শিক্ষিত ‘ব্রাহ্মণ্য’ সমাজ, উদ্যোগমুখী বৈশ্যসমাজ কিংবা দিনশ্রমিক শূদ্রসমাজ, সর্বত্রই সেই একই সংকট সমানে চলিতেছে।

সুতরাং প্রশ্নটি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে উঠিলেও সমস্যা শুধু সারস্বত গণ্ডির মধ্যেই আবদ্ধ নাই, সমাজ-অর্থনীতির পরতে পরতে তাহা প্রোথিত। অর্থনৈতিক ভাবে দেশীয় নাগরিকদের কর্মসংস্থান-বৃদ্ধির জন্য যে নীতি প্রণীত হইতেছে, তাহাই আবার সামাজিক কারণে উন্নয়ন ও প্রগতির প্রতিবন্ধক হইয়া দাঁড়াইতেছে। আসলে, দেশীয়তার যুক্তি যতই মহৎ হউক, মেধাভিত্তিক উৎকর্ষ ও দক্ষতাভিত্তিক সাফল্যের মহত্তর আদর্শের বিরুদ্ধে তাহাকে স্থাপন করিলে শেষ পর্যন্ত অর্থনীতিরই ক্ষতি। এই সাঁড়াশি সমস্যার সমাধান সহজ নয়। কিন্তু লাভ-ক্ষতির অঙ্কটি সহজ। পুরাতন সাম্রাজ্য-যুগীয় লাগামহীন আত্মপ্রসারের ফলে বিলাতি নাগরিকের যে ক্ষতিসাধন হইয়াছে, তাহার পূরণ ও নিরাময়ের জন্য যদি আজ বিলাতি রাষ্ট্রকে এমন সন্ত্রস্ত আত্ম-সংকোচন করিতে হয়, তবে তাহার দাম হিসাবে মর্যাদা-মান ও উৎকর্ষ-মানের হানি স্বীকার করিয়া লইতে হইবে। গত্যন্তর নাই।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

editorial anandabazar
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE