কলকাতার রাজপথ এক বিচিত্র স্লোগানে মুখরিত হল: হোক কলরব। ২০ সেপ্টেম্বরের বৃষ্টি-ধোওয়া কলকাতার রাস্তা থেকে আকাশের দিকে ছুড়ে-দেওয়া সহস্র কণ্ঠের ওই আওয়াজ শুনে মনে হচ্ছিল শব্দের আড়াল ভাঙছে, বহু ব্যবহারে ক্ষয়ে আসা স্লোগানের বৃত্ত মুছে গিয়ে নতুন উচ্চারণের ঢেউ উঠছে। ব্যাপারটা যে একটি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের ঘটনার প্রতিবাদে সীমিত নেই, তা সে দিন পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল। দাবি উঠেছিল রাষ্ট্রীয়, প্রাতিষ্ঠানিক, দলীয় ক্ষমতার বিরুদ্ধে, দাবির আওয়াজ আছড়ে পড়েছিল দমনপীড়নের নির্বিশেষ অস্তিত্বের বিরুদ্ধে। প্রবল বর্ষণের মধ্যে ক্যাম্পাস থেকে রাস্তা পেরিয়ে রাজপথে যে তরঙ্গ বড় হয়ে মিশে যাচ্ছিল তার সঙ্গত হিসেবে প্রয়োজন ছিল নতুন স্লোগানের। সব ক’টা কথা পুরনো মিছিলের মুখ থেকে ধার করে নিলে ব্যারিকেড গড়ে তোলার প্ররোচনাও মাটি হয়ে যায়। সেটাই হয়ে আসছিল বহু দিন ধরে। তাই উত্কর্ণ ছিলাম নতুন শব্দের জন্য। দেখা গেল একটি মূল দাবি উঠছে স্রেফ ধ্বনির স্বার্থে, হাজার হাজার গলায় আওয়াজ উঠছে: হোক কলরব।
ও পার বাংলার অর্ণবের গাওয়া যে গান থেকে এই আওয়াজ ধার করা সেটা প্রতিবাদের গান নয়। গানের লেখক রাজীব আশরাফ জানিয়েছেন এই অপ্রত্যাশিত নতুন জন্ম লাভ করে তাঁর রচনা সার্থক হয়ে উঠেছে। কথাটা ভাববার মতো। একটা পঙক্তি ছিঁড়ে তুলে আনা হয়েছে দুটি শব্দ, গোটা লাইনটার মধ্যে তার যা মানে ছিল তার থেকে অর্থ বদলে যাচ্ছে। কিন্তু নতুন কিছু সাজিয়ে বলা হচ্ছে না আপাতত। স্রেফ বলা হচ্ছে আওয়াজ উঠুক, অনেকগুলো কণ্ঠ ধ্বনি সৃষ্টি করুক। মনে হচ্ছিল, এটাই সবচেয়ে ছাত্রসুলভ। আমাদের চেনা যে স্লোগানের সংস্কৃতি, সেখানে ছাত্ররা প্রাজ্ঞ পার্টির শিখিয়ে দেওয়া বক্তব্য বহন করে, নিজেদের তৈরি স্লোগান বলে যদি কিছু থাকে সেটা অনুমোদন করিয়ে আনে ওপরতলার নেতাদের কাছ থেকে। এই জাতের রাজনীতি চলতে চলতে বহু বহু দিন আগে শিলীভূত জীবাশ্মে পরিণত হয়েছে, এর একটি ভঙ্গিও আর কোনও ভাবে সৃষ্টিশীল নেই।
এই মুহূর্তে তরঙ্গায়িত যে কলরব শুনছি তার পরিষ্কার বক্তব্য নেই এমন কথা কেউ বলবে না, স্পষ্ট দাবি নেই এমনটাও নয়। কবিতা থেকেই তৈরি হওয়া গান বলেছিল: ‘স্লোগান দিতে গিয়েই আমি চিনতে শিখি কে ভাই কে দুশমন’। তাত্ক্ষণিক দাবির এলাকা ছাড়িয়ে আন্দোলন যখন ছড়িয়ে পড়ে, আর তার পিছনে কোনও পলিতকেশ পলিটব্যুরো থাকে না, সব প্রশ্নের উত্তর জোগানো মানেবই থাকে না, তখন অনির্দিষ্টতাই একটা হাতিয়ার হয়ে উঠতে পারে। একে লক্ষ্যহীন, সংগঠনহীন বলে ভর্ত্সনা করে কোনও লাভ নেই। কী বলব সবটা জানা নেই বলেই শুধু বলছি ‘বলব’। আপাতত শুধু কলরব, সেটাই হোক। তার অনির্দিষ্ট অবয়ব থেকে সিনট্যাক্স তৈরি হবে, স্পষ্ট বাক্য উঠে আসবে, সেই সম্ভাবনার অবকাশ ছেড়ে রাখা যাক। একে প্রস্তুতিপর্বের লক্ষণ হিসেবে দেখলে কি খুব ভুল হবে?
২০০৭-এর গোড়া থেকে যে নতুন প্রতিবাদের পর্ব এই রাজ্যে শুরু হয়েছে তার সঙ্গে দুনিয়া জুড়ে তৈরি হয়ে ওঠা বিরুদ্ধতার নতুন ভাষার সব সময় অন্বয় ঘটেনি। ২০ সেপ্টেম্বর মনে পড়ে যাচ্ছিল ১৪ নভেম্বর, ২০০৭-এর নন্দীগ্রাম মিছিলের কথা। দুটো মিছিলই ছিল দলের পতাকাহীন, নেতৃত্বের দাবিদারহীন। এই প্রতিবাদপর্বের লক্ষণ এ সবই। পরিচিত রাজনৈতিক বাচন ছাপিয়ে বড় হয়ে উঠছে সাংস্কৃতিক অভিব্যক্তি, সেটাও আর একটা লক্ষণ। ১৪ নভেম্বরের মিছিল ছিল নীরব, স্লোগানহীন। সেই নিরুক্তিকে নানা ভাবে শোনা গিয়েছিল, তাকে অনাগত বাক্যের প্রস্তুতি রূপে শোনার অবকাশ তৈরি হয়েছিল। ওই বছর জুড়ে একের পর এক স্বতঃস্ফূর্ত সমাবেশে যখন রাজনৈতিক পালাবদলের সূত্রপাত হচ্ছে তখন দেখছিলাম, নতুন ওই আন্দোলনের ভাষা পুরনো, প্রায় অচল সব বুলিতে আটকা পড়ে যাচ্ছে। তাই নভেম্বরের ক্লাইম্যাক্সে পৌঁছে ওই মৌন অবলম্বনের অন্য গুরুত্ব ছিল। তার পর সে দিন রাস্তায় আকাশ-ফাটানো ‘হোক কলরব’ শুনে মনে হল এর পরের অধ্যায় সূচিত হচ্ছে। তার অভিমুখ যাদবপুরের ঘটনার প্রতিবাদ থেকে ব্যাপ্ত হয়ে যাবতীয় দমন ক্ষমতার উত্স, সরকার, শাসক দল, রাষ্ট্রের দিকে ঘুরে গেছে।
নব্বইয়ের দশকের শুরুই হয় তিয়েন-আন-মেন স্কোয়ার, পূর্ব ইউরোপের পালাবদল, বার্লিন প্রাচীরের ধ্বংসের মধ্যে দিয়ে। বিশ শতক জুড়ে যে রাজনীতি বিপ্লবের সমার্থক হয়ে দাঁড়িয়েছিল, ওই দশকের দোরগোড়ায় এসে দেখা গেল তার বিরুদ্ধেই সংগঠিত হচ্ছে একের পর এক বিদ্রোহ। এর আগেই ইঙ্গিত পাওয়া গিয়েছিল। ষাটের দশকের শেষ দিকে তিন-চার বছরে দুনিয়ার একটা বড় অংশ ছাত্রদের দখলে চলে গিয়েছিল। প্যারিস বার্লিন লন্ডন বার্কলে জুড়ে ‘স্টুডেন্ট পাওয়ার’ নামক নতুন শক্তির নামকরণ করা হয়েছিল। এদের বিপ্লবী স্বপ্ন দরবারি বামপন্থার হাত ছাড়িয়ে বেরিয়ে গিয়েছিল বার বার; কন বেন্ডিট ‘অবসলিট কমিউনিজ্ম’ নামে ইস্তেহার লিখে ফেলেছিলেন। নব্বইয়ের দশকের মোড়বদল পুঁজিবাদের ষড়যন্ত্র বলে নস্যাত্ করে যাঁরা ভাবছিলেন সাবেক সমাজতন্ত্র কোন মন্ত্রে ফিরিয়ে আনা যায়, তাঁরা ওই সময় থেকেই বিশ্ব জুড়ে গড়ে ওঠা নতুন জন-আন্দোলনের স্বভাব বোঝার মতো অবস্থায় ছিলেন না। সহজলভ্য প্রযুক্তি আর সংযোগ ব্যবস্থার বৈপ্লবিক পরিবর্তন মানুষের শ্রমের, চিন্তার, সম্পর্কের চরিত্র আমূল বদলে দিয়েছে। ক্ষমতার আর শাসনের চরিত্র যেমন বদলেছে তেমনি বদলেছে সমাবেশের, সঙ্ঘের চেহারাও। নানা শ্রেণি ও মতের মানুষ একসঙ্গে রাস্তায় নেমেছে, অবরোধ করেছে, স্থানীয়, সাময়িক জোট ও নেতৃত্ব গড়ে নিয়েছে। এ সব আন্দোলনের চরিত্র বিশ শতকের গোড়ার রাষ্ট্রবিপ্লবের মতো নয়, কোনও ‘ভ্যানগার্ড’ শ্রেণি বা পার্টির হাতেও ভুবনের ভার নেই আপাতত। রাজপথে সাইবারপথে এরা ঝলসানো উল্কি, অসমাপ্ত ইমেজ, টুকরো কথার সম্ভার রচনা করছে, পার্টিপুস্তক আওড়াচ্ছে না।
ধারাবাহিকতার অবলোপ ঘটাতে হবে এ কথা কেউ বলছে না। বিপ্লব করতে গিয়ে অজান্তেই অতীতের পুনরভিনয় ঘটিয়েছে এক একটা যুগ, অতীত থেকে নাম পরিচ্ছদ ভাষা ধার করে নতুন নাটক মঞ্চস্থ করেছে। ট্র্যাজেডি আর ফার্স-এর পুনরাবৃত্তির চক্র থেকে মুক্ত হবে যে নতুন বিপ্লব তার ভাষা তাই বদলাতে বাধ্য। আগে যদি শব্দ বিষয়বস্তুকে ছাপিয়ে গিয়ে থাকে এখন তবে বিষয়বস্তু শব্দকে অতিক্রম করে যাবে ‘অষ্টাদশ ব্রুমেয়ার’-এ মার্ক্স লিখেছেন।
ক্ষমতার উত্স যত প্রতিষ্ঠানের স্বাভাবিক হিংস্রতার বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছিল ২০ সেপ্টেম্বরের মিছিল। যে পর্বের আন্দোলনে এরা শামিল সেখানে খেতখামারে ব্যারিকেড গড়ে তোলার ডাক দিলে কি তার বিশেষ অর্থ কিছু পড়ে থাকে, না কি শব্দ বিষয়বস্তুকে ছাপিয়ে ওঠে? পুলিশকে লক্ষ করে এখন তার একশো বারো টাকা মাইনের কথা বললে সলিডারিটির আহ্বান জানানো হয় না, বরং অপমান করা হয়। সে দিনের আরও ভাল স্লোগান ছিল: ‘পুলিশ তোমায় জাপটে ধরে, গান শোনাব বিশ্রী সুরে।’ ক্ষমতায় যারা পৌঁছয় ঠাট্টার প্রতিভা তাদের ত্যাগ করে। ষাট-সত্তরের তুখড় বিদ্রুপে মুখরিত দেওয়ালগুলো দীর্ঘ বাম জমানায় পরিপাটি মামুলি লিখনে ভরে উঠেছিল। বিরোধী মুখ থেকেই তখন ক্বচিত্ উজ্জ্বল সব মস্করা ফিরে পাওয়া যেত। লোডশেডিং-গ্রস্ত আশির দশকে কংগ্রেসও লিখতে পেরেছিল: ‘রাজ্যের হাতে অধিক মোমবাতি চাই’, কিংবা গোর্খাল্যান্ড পর্বে: ‘কমরেড, বুকের রক্ত ব্লাড ব্যাঙ্কে দিন’। আমাদের গলির ভিতরে কারা লিখে গিয়েছিল: ‘সামনে লেনিন, পিছনে হো চি মিন, মাঝখানটায় গুছিয়ে নিন।’ এই সে দিন ইরাক যুদ্ধে পাঠানো বোমারু বিমান দমদমে নামিয়ে তেল ভরার মার্কিনি চেষ্টার পর ক্যাম্পাসে লেখা হয়েছিল: ‘কলকাতায় যুদ্ধ বিমান নামল কেন বুদ্ধ বিমান জবাব দাও।’ আপাতত অজস্র ছড়া প্যারডি কার্টুনের বিস্ফার দেখে মনে হচ্ছে আবার একটা তুমুল মস্করার মুহূর্ত ফিরে এসেছে।
এটা উত্সবের মুহূর্ত, যখন তীব্র রাগ থেকে ঠাট্টার স্রোতে নেমে নিজেকে নিয়েও হাসার সুযোগ পাওয়া যায়। সব ক’টা কথা নির্ধারিত, নির্দিষ্ট থাকে না। কিছু স্পষ্ট দাবি থাকে, আর কিছু কথা ঘুরে ঘুরে নানা অর্থ ছুঁয়ে কখনও এখানে কখনও ওখানে দাঁড়িয়ে যায়। কলকাতা থেকে সিউড়ি, বেঙ্গালুরু থেকে দিল্লি, ঢাকা থেকে নিউ ইয়র্ক, অর্ণবের, রূপম ইসলামের মাতৃভাষা জেনে না জেনে রোজ নতুন নতুন সমাবেশ বলছে ‘হোক কলরব’। আপাতত উত্সব হোক, বিস্তর চেঁচামিচি, কোন কথাটা শাসন করবে, সে সব আগে থেকে না জেনেই।
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে চলচ্চিত্রবিদ্যার শিক্ষক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy