ইতিহাস সৃষ্টির সুযোগ আসিয়াছিল। এবং বৃথা চলিয়া গেল। কলিকাতা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি মঞ্জুলা চেল্লুর সুযোগটি তৈয়ারি করিয়াছিলেন, কিন্তু আক্ষেপের কথা, তাহার সদ্ব্যবহার করিলেন না। বার অ্যাসোসিয়েশন-এর আবদার ছিল, আইনজীবীরা বৃহস্পতিবার দোলের পরে শুক্রবার হোলির দিনেও কাজ করিবেন না। এই আবদারের পিছনে ছিল নবান্নের অনিবার্য প্রেরণা। ছুটি মঞ্জুরিতে মুখ্যমন্ত্রী রাজা হরিশচন্দ্রকেও লজ্জা দিতে পারেন, তিনি হোলির বাড়তি ছুটি দিয়া কর্মীদের চার দিনের দীর্ঘ অবকাশ কাটাইতে বাড়ি পাঠাইয়া দেন। অতএব উকিলদেরও দাবি ছিল: দোলেরও খাইবেন, হোলিরও কুড়াইবেন। কিন্তু প্রধান বিচারপতি তাঁহাদের অন্যায় আবদারে আপত্তি জানাইয়াছিলেন। তাঁহার প্রস্তাব ছিল: হোলিতে যদি ছুটি লইতেই হয়, তবে অন্য কোনও ছুটির দিনে কাজ করিয়া আইনজীবীরা ক্ষতি পূরণ করিয়া দিন। আইনজীবীরা তাহাতে নারাজ। সুতরাং শুক্রবারে হাইকোর্টে অতি অল্পসংখ্যক আইনজীবী কাজে আসেন এবং আদালতের কাজ কার্যত বন্ধ থাকে। প্রধান বিচারপতির গুরুত্বপূর্ণ এবং সৎ উদ্যোগটি বানচাল হইয়া যায়।
এই পরিণতি কি এড়ানো যাইত না? আইনজীবীদের অসহযোগিতা সত্ত্বেও কি আদালতের কাজ, অন্তত অংশত, নির্বাহ করা সম্ভব ছিল না? আইন, কর্মবিধি এবং সর্বোপরি সুপ্রিম কোর্টের একটি নির্দেশ বিচার করিলে কিন্তু মনে করিবার কারণ আছে যে, কলিকাতা হাইকোর্ট ঘটনাপ্রবাহকে অন্য দিকে চালিত করিতে পারিতেন। ২০০২ সালে সর্বোচ্চ আদালত নির্দেশ দিয়াছিলেন যে, আইনজীবীদের ধর্মঘট বা বয়কটের কারণে আদালতের কাজ বন্ধ করিবার কিছুমাত্র প্রয়োজন নাই। এই নির্দেশের অন্তর্নিহিত তাৎপর্য স্পষ্ট: আইনজীবীরা বিচারপ্রক্রিয়ার অ-পরিহার্য অঙ্গ নহেন। বস্তুত, তাঁহাদের ভূমিকা সহায়কের। আদালতে তাঁহাদের মৌখিক সওয়াল ব্যতিরেকেই মামলার নিষ্পত্তি সম্ভব— বিচারপতিরা প্রয়োজনীয় নথিপত্র দেখিয়াই সিদ্ধান্ত স্থির করিতে পারেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তো বটেই, এ দেশেও তেমন বিচার সম্পন্ন হইয়াছে। কলিকাতা হাইকোর্টের সামনে সেই সুযোগ আসিয়াছিল। পথ প্রদর্শনের সুযোগ। অন্তত কিছু মামলা যদি সে দিন পলাতক আইনজীবীদের বাদ দিয়াই নিষ্পন্ন হইত, তাঁহারা একটি কঠিন সংকেত পাইতেন। এই সংকেত যে, তাঁহাদের বাদ দিয়াও আদালত চলিতে পারে। তাহাতে হয়তো তাঁহাদের ফাঁকি-মনস্ক যূথশক্তি কিঞ্চিৎ ধাক্কা খাইত। সোমবার বার অ্যাসোসিয়েশনের সভায় উকিলরা যে ভাবে প্রধান বিচারপতির বাড়তি ছুটির বদলে অন্য দিন কাজ করিবার প্রস্তাবটি বাউন্ডারির বাহিরে পাঠাইয়া দিয়াছেন, ততটা স্পর্ধা হয়তো তাঁহারা সংগ্রহ করিতে পারিতেন না। এই কারণেই খেদ রহিয়া গেল।
খেদ রহিয়া গেল গভীরতর কারণেও। ভারতে বিচারব্যবস্থার সমস্যা বহুবিধ, কিন্তু একটি প্রধান ও ব্যাপক সমস্যা বিলম্বিত বিচার। বিলম্বের বহু কারণ আছে। কিন্তু একটি মূল কারণ নিহিত থাকে বিচারের প্রক্রিয়াতেই। যে মামলা এক দিনে সম্পন্ন হইবার কথা, তাহা বছরের পর বছর গড়াইতে থাকে। এই দীর্ঘসূত্রিতার পিছনে আইনজীবীদের ভূমিকা সুবিদিত। তাঁহাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, অংশত ইচ্ছাকৃত ভাবে, অংশত রীতির বশে তাঁহারা মামলা প্রলম্বিত করিতে থাকেন। মহামান্য বিচারপতিরা নথিপত্রের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণের রীতি অনুসরণ করিলে এই ধরনের বিলম্ব কমিবার বিপুল সম্ভাবনা তৈয়ারি হইতে পারে। প্রথমে এই পরিবর্তনে কিছু সমস্যা থাকিতে পারে, যে কোনও পরিবর্তনেই সমস্যা থাকে। কিন্তু চাপে পড়িলে অনেক সমস্যার সমাধান হয়, তখন ভাবিতেই বিস্ময় জাগে যে কোনও সমস্যা ছিল। বিচারপতিরা চাপ সৃষ্টি করিতে পারিলে বিচারব্যবস্থার মঙ্গল।