Advertisement
E-Paper

খোলা হাওয়া

ধর্মও তবে কখনও কখনও যুগধর্ম মানিয়া চলে। সকলকে বিস্ময়ে হতবাক করিয়া ভ্যাটিকানে ধ্বনিত হইল সমকামী মানুষদের প্রতি সহমর্মিতার ভাষা। পোপ ফ্রান্সিস-এর উপস্থিতিতে, তাঁহারই উদ্বোধিত সভায়, দুইশত বিশপের সভায় ঘোষিত হইল যে, সমকামী মানুষদের নিকট হইতেও খ্রিস্টীয় সমাজের অনেক কিছু শিখিবার আছে, তাঁহাদেরও খ্রিস্ট-সমাজে স্থান দেওয়া প্রয়োজন। প্রাতিষ্ঠানিক ক্যাথলিক সভা হইতে এই উচ্চারণ অবশ্যই ঐতিহাসিক।

শেষ আপডেট: ১৮ অক্টোবর ২০১৪ ০০:০৫

ধর্মও তবে কখনও কখনও যুগধর্ম মানিয়া চলে। সকলকে বিস্ময়ে হতবাক করিয়া ভ্যাটিকানে ধ্বনিত হইল সমকামী মানুষদের প্রতি সহমর্মিতার ভাষা। পোপ ফ্রান্সিস-এর উপস্থিতিতে, তাঁহারই উদ্বোধিত সভায়, দুইশত বিশপের সভায় ঘোষিত হইল যে, সমকামী মানুষদের নিকট হইতেও খ্রিস্টীয় সমাজের অনেক কিছু শিখিবার আছে, তাঁহাদেরও খ্রিস্ট-সমাজে স্থান দেওয়া প্রয়োজন। প্রাতিষ্ঠানিক ক্যাথলিক সভা হইতে এই উচ্চারণ অবশ্যই ঐতিহাসিক। এত দিন পর্যন্ত প্রকৃতিবিরুদ্ধতার অভিযোগে ভ্যাটিকান সমকামীদের ধর্মচ্যুত বলিয়াই বিবেচনা করিত। পূর্ববর্তী দুই পোপ, পোপ দ্বিতীয় জন পল ও পোপ দ্বিতীয় বেনেডিক্ট দ্ব্যর্থহীন ভাবে সমকামী আচরণের তীব্র বিরোধিতা করিয়াছেন। এই মুহূর্তে ক্যাথলিক চার্চের যে সংবলিত ধর্মশিক্ষা পাওয়া যায়, সমকাম বিষয়টি তাহার সর্বৈব বিরোধী। সুতরাং এই নূতন বক্তব্যে ইউরোপ আমেরিকায় ক্যাথলিক যাজকদের গলায় কেবল বিস্ময় নয়, ক্ষোভ ও অস্বীকৃতি ঝরিয়া পড়িতেছে। এমনকী ভ্যাটিকানেও ইতিমধ্যেই অনেকে প্রকাশ্যত আপত্তি জানাইতেছেন। এমতাবস্থায় আসিল বৃহস্পতিবারের সংশোধিত অনুবাদ, যাহাতে মূল বিবৃতিতে সমকামীদের প্রতি যে সমর্থন জ্ঞাপিত হইয়াছিল, তাহা অনেকাংশেই খর্বিত ও সংক্ষেপিত দেখা যাইতেছে। মূল বিবৃতি বলিয়াছিল ‘ফ্রেটারনিটি’ বা ‘ভ্রাতৃত্ব’-এর কথা। অনূদিত বিবৃতি বলিল, ‘ফেলোশিপ’ বা সহযোগের কথা। তবে বৃহস্পতিবার তো আর মঙ্গলবারকে অনস্তিত্বশীল করিয়া দিতে পারে না। সমকামের প্রতি স্বীকৃতি-সূচক মন্তব্যে শাস্ত্র-সূত্র-সীমার বাহিরে বার হইয়া ক্যাথলিক চার্চ যে সামাজিক সহনশীলতার দৃষ্টান্ত প্রকাশ করিয়া ফেলিয়াছে, ইতিহাস তাহা ভুলিবে না।

পোপ ফ্রান্সিসের অধীনে ভ্যাটিকানের এই নব-অভিমুখ অবশ্য অপ্রত্যাশিত নহে। ভ্যাটিকানের শীর্ষ আসনে অধিষ্ঠিত হইবার পরে তিনি বিভিন্ন প্রশ্নে আপন মনোভঙ্গির পরিচয় দিয়াছেন। সেই মানসিকতা তাঁহার পূর্বসূরিদের তুলনায় লক্ষণীয় ভাবে উদারপন্থী। বৎসরের সূচনায় দক্ষিণ আমেরিকায় সফরকালেও তিনি এই উদার দৃষ্টির ইঙ্গিত দিয়া ‘হোমোসেক্সুয়াল’ শব্দটির বদলে সহজবোধ্য, জনপ্রিয় ইংরেজি প্রতিশব্দ ‘গে’ উচ্চারণ করিয়াছিলেন। বুঝাইয়াছিলেন, এই মানুষদের তিনি স্বীকৃতির চোখেই দেখিতে চাহেন। এমনও বলিয়াছিলেন যে, ইঁহারাও যখন ঈশ্বরসন্ধান করেন, এবং সুবুদ্ধিচালিত হন, তখন পোপ তাহাতে প্রশ্ন তুলিবেন কোন অধিকারে! তবে সে ছিল তাঁহার ব্যক্তিগত মত, কোনও প্রাতিষ্ঠানিক অবস্থান নয়। সেই বিচারে ভ্যাটিকানের যুগযুগান্তের শিরোমর্যাদাময় মঞ্চ হইতে এ কথা বলার গুরুত্বই আলাদা।

লক্ষণীয়, দুইশত বিশপের সভা কিন্তু মুক্তকণ্ঠে সমকামিতাকে সিদ্ধ কিংবা স্বীকৃত আখ্যা দেয় নাই। বস্তুত ইহার বৈধতা বিষয়ে কোনও মন্তব্যই করে নাই। বরং প্রকারান্তরে জানাইয়া দেওয়া হইয়াছে যে, তেমন স্বীকৃতির কোনও সম্ভাবনা নাই। তাহা অস্বাভাবিক নহে, কারণ ক্যাথলিক খ্রিস্টধর্মে সন্তান প্রজনন ব্যতীত যৌন সম্পর্ক মূলত অনৈতিক বলিয়া নির্দিষ্ট। এই প্রেক্ষিতেই বিশপদের প্রাথমিক ছাড়পত্র তাৎপর্যপূর্ণ। তাঁহারা যাহা ও যতটুকু বলিয়াছেন, তাহাতে ব্যাখ্যা করা যায় যে সমকামিতা ধর্মমতে অবৈধ ও অসিদ্ধ হইলেও ধর্মসমাজের ভিতরেও তাহার স্থান সম্ভব। ‘অন্য’ ও ‘ভিন্ন’ বলিয়াই হাঁড়ি আলাদা করিবার কিংবা তাহাকে অগ্রাহ্য করিবার যুক্তি নাই। এই ব্যাখ্যা অনুসারে কিন্তু ভ্যাটিকানের বিশেষ অবস্থানটি ধর্মের পরিসরের মধ্যেই এক ‘অন্য’ ও ‘ভিন্ন’ সহনশীলতার দরজা খুলিয়া দেয়। এই সহনশীলতা মানবসভ্যতার ইতিহাসে হয়তো সম্পূর্ণ অপরিচিত নহে, কিন্তু প্রাত্যহিক পরিচিতিও তাহার নাই। সার্বিক অসহনশীলতার এই তমসায়, পোপ ফ্রান্সিসের ভ্যাটিকান যেন ক্ষণিকের জন্য একটি উজ্জ্বল বিজুলিরেখা খেলাইয়া দিল।

anandabazar editorial
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy