বিপরীত মেরু পরস্পরকে আকর্ষণ করে, কেবল প্রেমে নয়, কখনও কখনও এমনকী রাজনীতিতেও। গ্রিসে ‘অতি-বাম’ দল সিরিজা সাম্প্রতিক নির্বাচনে বিপুল সাফল্য অর্জন করিলেও জোট গড়িতে বাধ্য হইয়াছে। সেই জোটে তাহার শরিক ইন্ডিপেন্ডেন্ট গ্রিকস নামক দলটি ‘অতি-দক্ষিণ’ বলিয়া পরিচিত। এমন জোটের রহস্যটি কী? তাহার উত্তর আছে গ্রিস তথা ইউরোপের অর্থনীতি ও রাজনীতির মোহানায়। পাঁচ বছর আগে গ্রিসের আর্থিক সংকটের স্বরূপ প্রকট হয়, ২০১১ সালে রাজপথের তুমুল বিক্ষোভে তাহার বিস্ফোরণ ঘটে। অতঃপর ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ), ইউরোপিয়ান কমার্শিয়াল ব্যাঙ্ক (ইসিবি) এবং আন্তর্জাতিক অর্থ ভাণ্ডারের (আইএমএফ) ‘ত্রয়কা’ বা ত্রয়ী-র আর্থিক সাহায্যের জোরে দেশটি কোনও ক্রমে নিজেকে সচল রাখিয়াছে। কিন্তু সেই সাহায্যের শর্ত হিসাবে উত্তমর্ণ-ত্রয়ী কৃচ্ছ্রসাধনের কর্মসূচি জারি করে। কৃচ্ছ্রসাধনের ফলে অর্থনীতির দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্য ফিরিবার কিছু লক্ষণ দেখা দিয়াছিল, কিন্তু ভোটের রাজনীতিতে ভবিষ্যৎ স্বাস্থ্য অপেক্ষা বর্তমান টানাটানি অনেক বেশি প্রভাব বিস্তার করে। গ্রিসের নির্বাচনে তাহারই ফল ফলিয়াছে: ‘কৃচ্ছ্রসাধনের নীতি চলিবে না’ বলিয়া প্রচার করিয়া সিরিজা-র নায়ক অ্যালেক্সিস সিপ্রাস বাজিমাত করিয়াছেন।
কিন্তু ইন্ডিপেন্ডেন্ট গ্রিক্স কেন তাঁহার হাত ধরিল? সেখানেই ইউরোপের রাজনীতি। এই দল কট্টর স্বাতন্ত্রবাদী। তাহাদের দাবি: গ্রিস নিজের মতে চলিবে, ব্রাসেলস অর্থাৎ ইইউ-এর সদর দফতর হইতে তাহার নীতি নির্ধারণ চলিবে না। জনসাধারণের কৃচ্ছ্রসাধন নহে, জাতীয় সার্বভৌমত্বের অভিমানই এই দলটির প্রধান চালিকাশক্তি। আপাতত দুই মেরুর সমাপতন ঘটিয়াছে। অতঃপর নূতন সরকার কী ভাবে উত্তমর্ণদের মোকাবিলা করে, তাহা অতি কঠিন প্রশ্ন। ত্রয়ী, বিশেষত ইউরোপের প্রধান আর্থিক শক্তি ও এক নম্বর গৌরী সেন জার্মানি জোর দিয়া বলিতেছে, গ্রিস কৃচ্ছ্রসাধনের পথে থাকিবে বলিয়া চুক্তিবদ্ধ, সে পথ ছাড়া চলিবে না, ‘আমাদের নীতি ভোটের ময়দানে স্থির হয় না’। আথেন্সের নূতন নায়কদের জবাব: মহাজনের চোখরাঙানিতে ভীত হইয়া তাঁহারা দেশবাসীকে যন্ত্রণা দিবেন না। ইতিমধ্যেই গ্রিসে সরকারি কর্মীরা হারানো কাজ ফিরিয়া পাইতেছেন।
গ্রিসের অর্থনীতির মৌলিক সমস্যা সহজ ও স্পষ্ট: আয় কম, ব্যয় বেশি। এই ঘাটতি নিয়ন্ত্রণ করিতেই হইবে। প্রশ্ন: কী ভাবে, কত দিনে তাহা করা হইবে। ইইউয়ের সম্মিলিত অর্থনীতিকে সম্মিলিত রাখিতে গেলে ইহার সদুত্তর আবশ্যক। গ্রিসের পক্ষেও আবশ্যক, ইইউয়ের পক্ষেও। জার্মানি ও ইইউ যতই দাপট দেখাক, আথেন্সের উপর রাগ করিয়া তাহাকে পরিত্যাগ করা তাহাদের পক্ষে কঠিন। সমস্যা কেবল গ্রিসকে লইয়া নয়, স্পেন বা এমনকী ইটালির মতো দেশেরও আর্থিক সংকট প্রবল, কৃচ্ছ্রসাধনের বিরুদ্ধে জনমতও প্রবল। এই বিক্ষোভ ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতি বিরূপতায় ইন্ধন জোগাইতেছে। স্পেনের পোদেমোস বা ইংল্যান্ডের ইউকিপ-এর মতো স্বাতন্ত্রবাদী দলগুলির জনপ্রিয়তা উত্তরোত্তর বাড়িতেছে। প্রসঙ্গত, এই দুই দেশেই নির্বাচন অদূরে। ইউরোপকে মিলিত রাখিতে হইলে কৃচ্ছ্রসাধনের অর্থনীতির সহিত গণতান্ত্রিক রাজনীতিকেও মিলাইতে হইবে। ভোটের ময়দানকে বাদ দিয়া নীতি স্থির করা চলিবে না। পশ্চিমী গণতন্ত্রের উৎসভূমি আথেন্সে সত্যটি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ হইয়া উঠিল।