ব্রিটেনের পার্লামেন্টে প্রিয়া পিল্লাই যে ভাষণটি দিতেন, তাহাতে ভারতের উন্নয়ন কর্মসূচির কতখানি ক্ষতি হইত, সে প্রশ্ন অবান্তর। উন্নয়নের সহিত পরিবেশের বিরোধ আছে, তাহা অনস্বীকার্য। পরিবেশকর্মীরা অনেক সময়েই সেই বিরোধে উন্নয়নের প্রতিকূল ভূমিকায় থাকেন, তাহাও সুবিদিত। কিন্তু, গ্রিনপিস নামক অসরকারি সংস্থাটির প্রতিনিধি প্রিয়া পিল্লাই যদি তাঁহার সম্পূর্ণ ভাষণটিই ভারতের অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রক্রিয়ার বিরোধিতায় ব্যয় করিতেন, তবু তাঁহার সেই বাক্স্বাধীনতা রোধ করিবার অধিকার সরকারের নাই। কেন্দ্রীয় সরকার কোন মানসিকতা হইতে যে কোনও বিরোধী স্বরের কণ্ঠরোধ করিতে চাহিতেছে, এক্ষণে তাহা ভাবিবার। এবং, সেই গণতন্ত্রহীনতার আয়ুধ কী, তাহাও লক্ষণীয়। ইন্ডিয়া’জ ডটার নামক তথ্যচিত্রটি নিষিদ্ধ করিতে যে অস্ত্র ব্যবহৃত হইয়াছে, প্রিয়া পিল্লাইয়ের বিদেশযাত্রা ঠেকাইতেও তাহাই হাতিয়ার ছিল। অস্ত্রের নাম ‘জাতীয়তাবাদ’। সরকারি আইনজীবীর যুক্তির উত্তরে দিল্লি হাইকোর্ট বলিয়াছে, বিদেশের মাটিতে নিজের মত ব্যক্ত করাকে কোনও অর্থেই দেশবিরোধী কাজ বলা চলে না। আরও এক ধাপ আগাইয়া বলা চলে, সরকার যে ‘জাতীয়তা’-র ঢাক পিটিতেছে, তাহার গোড়ায় খুব বড় রকমের গলদ। বস্তুত, ‘জাতীয়তাবাদ’ শব্দটি তাহার জন্মলগ্ন হইতেই সমস্যাসঙ্কুল, এবং রাজনৈতিক (অপ)ব্যবহার-সাপেক্ষ। দিন বদলাইয়াছে। ব্যবহার বদলায় নাই। এখনও সুবিধা দেখিয়াই জাতীয়তাবাদের বিড়ালটি ঝুলি হইতে বাহির করাই দস্তুর। রাষ্ট্র যখন জাতীয়তাবাদের দোহাই পাড়ে, তখন সাবধান হওয়া বিধেয়।
প্রিয়া পিল্লাইয়ের ক্ষেত্রে এই জাতীয়তাবাদের দোহাইয়ে একটি বাড়তি সুর জুড়িয়াছে। সরকারের বক্তব্য, ভারতের উন্নয়ন কর্মসূচিকে ব্যাহত করিতে বিভিন্ন অসরকারি সংস্থার মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা আসিতেছে। প্রিয়াও বিদেশি টাকাতেই বিদেশ সফরে যাইতেছিলেন। দিল্লি হাইকোর্ট তাহাতে আপত্তিজনক কিছু দেখে নাই। বরং, একটি ভিন্ন আপত্তি প্রাসঙ্গিক। ভারতে বিদেশি অর্থের ব্যবহার লইয়া এখনও কেন আইন রক্তচক্ষু দেখাইবে? টাকার রাষ্ট্রপরিচয় বিচার করিয়া অপরাধের গুরুত্ব ধার্য করিবার মানসিকতাটি ১৯৯১ সালের জুলাইয়েই ফেলিয়া আসা বিধেয় ছিল। যত ক্ষণ না অন্যায় পথে আসিতেছে বা খরচ হইতেছে, তত ক্ষণ সেই অর্থের পাসপোর্ট দেখিতে চাহিবার কোনও যুক্তি নাই। আর, অন্যায় হইলে তাহা যে দেশের মুদ্রাতেই হউক, সমান দণ্ডনীয় হওয়াই বিধেয়। আইনগুলি যুক্তিহীন। তবুও আছে যখন, তাহা মানিয়া চলিতে হইবে। প্রিয়া পিল্লাই কোনও আইন ভাঙিতেছিলেন কি না, তাহা দেখিবার অধিকার সরকারের বিলক্ষণ আছে। কিন্তু, তিনি বিদেশি সাহায্যে বিদেশ ভ্রমণ করিতেছিলেন, শুধু এইটুকুই তাঁহাকে অপরাধী বলিয়া দাগিয়া দেওয়ার যুক্তি হইতে পারে না।
প্রিয়া পিল্লাইকে শেষ মুহূর্তে আটকাইয়া দেওয়া বা অতি তত্পর হইয়া তাঁহার বিরুদ্ধে আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ আনাই হউক, অথবা ‘ইন্ডিয়া’জ ডটার’ নামক তথ্যচিত্রটিকে নিষিদ্ধ করিয়া দেওয়া, সরকার স্পষ্টতই অসহিষ্ণুতার পরিচয় দিতেছে। গণতান্ত্রিক পরিসরে, স্বাধীন মতপ্রকাশের মাধ্যমে নিজের অবস্থান প্রতিষ্ঠা করিতে যুক্তির যে জোর লাগে, অধ্যবসায় প্রয়োজন হয়, এবং সর্বোপরি নিজের অবস্থানটির উপর যে আস্থা থাকিতে হয়, সেগুলির অভাবই অসহিষ্ণুতার কারণ। সেই অসহিষ্ণুতা ঢাকিতে জাতীয়তাবাদ নামক চাদরের খোঁজ পড়ে— যেন জাতির স্বার্থেই সরকারকে এমন অপ্রিয় কাজগুলি করিতে হইতেছে। এই চৌকিদারি ছাড়াও ভারতের চলিবে। ভারতীয় গণতন্ত্রের সে জোর আছে যাহাতে বহু বিরুদ্ধ স্বর, তাহাদের যাবতীয় তর্ক সমেত, সহাবস্থান করিতে পারে। দেশের কাঁধে বন্দুক রাখিয়া রাষ্ট্রীয় অসহিষ্ণুতা ঢাকিবার খেলাটি এই বার বন্ধ হইলেই ভাল।