ক্ষুদ্রতা সর্বগ্রাসী। যে কোনও বৃহৎ উদ্যোগের সম্ভাবনাকে সে অনায়াসে বিনাশ করিতে পারে। নরেন্দ্র মোদী ও শশী তারুর সংক্রান্ত সাম্প্রতিক ঘটনাবলিতে কংগ্রেসের আচরণ তাহারই নূতন প্রমাণ। মোদী এবং তারুর কখনও পরস্পরের প্রতি বিশেষ অনুরক্ত ছিলেন না। টুইটার নামক যুদ্ধক্ষেত্রে তাঁহাদের বিসংবাদ এক কালে ব্যক্তিগত আক্রমণের স্তরে নামিয়া গিয়াছিল। সেই দুই রাজনীতিক যদি পরস্পরের দিকে সদিচ্ছার হাত বাড়াইয়া দেন, তবে তাঁহাদের অকুণ্ঠ সাধুবাদ প্রাপ্য। নরেন্দ্র মোদী তাঁহার ‘স্বচ্ছ ভারত অভিযান’-এ যে নয় জন বিশিষ্ট মানুষকে আমন্ত্রণ জানাইয়াছেন, শশী তারুর তাঁহাদের এক জন। এবং, সেই তালিকায় তারুরই একমাত্র রাজনীতিক। প্রধানমন্ত্রীর বাড়াইয়া দেওয়া হাতটি তারুর প্রত্যাখ্যান করেন নাই, বরং সম্পূর্ণ সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি দিয়াছেন। গত এক দশকে কংগ্রেস ও বিজেপি যে অসহযোগের সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা করিয়াছে, সেই প্রেক্ষাপটে ঘটনাটি অতি উজ্জ্বল ব্যতিক্রম। কিন্তু, কংগ্রেসের গোঁসা হইয়াছে। কেরল কংগ্রেস জানাইয়াছে, তাহারা বাক্স্বাধীনতাকে সম্মান করে, কিন্তু সেই স্বাধীনতার ভরসায় কেহ দলীয় লাইনের বাহিরে কথা বলিলে তাহা সহ্য করা হইবে না।
শশী তারুর যে কংগ্রেসের টিকিটেই সংসদে পা রাখিয়াছেন, সেই কথাটিও কেরলের নেতারা তাঁহাকে স্মরণ করাইয়া দিয়াছেন। কংগ্রেসের সাংসদ হইলে বিজেপি-র প্রধানমন্ত্রীর সহিত কোনও রূপ সহযোগিতা করা চলিবে না, দলীয় নেতৃত্ব এই সরল ও ব্যবহৃত যুক্তিতেই আস্থাবান। অবস্থানটি অভিনব নহে। দীর্ঘ কাল যাবৎ ভারতীয় রাজনীতি এই সমীকরণেই চলিয়াছে। কিন্তু, সেই গড্ডলিকাপ্রবাহ হইতে সরিয়া দাঁড়াইবার সুযোগ পাইয়াও কংগ্রেস যে ভাবে তাহাকে প্রত্যাখ্যান করিল, তাহাতে স্পষ্ট ক্ষুদ্রতাই তাহাদের রাজনীতির সার। ভারতের জাতীয় দল, অথবা জাতীয়তাবাদী দল হইবার গালভরা দাবিগুলি নেহাতই কথার কথা। ‘স্বচ্ছ ভারত অভিযান’ একটি ব্যতিক্রমী সুযোগ ছিল। প্রকল্পটি রাজনীতিহীন তো বটেই, ভারতের সার্বিক উন্নয়নের জন্য এই রূপ প্রকল্পের প্রয়োজনীয়তাও অনস্বীকার্য। কংগ্রেস জমানার নীতির সহিতও তাহার সংঘাত নাই। তারুর প্রধানমন্ত্রীর আমন্ত্রণ গ্রহণ করিয়াই জানাইয়াছিলেন, নেহাত প্রতীকে তাঁহার উৎসাহ নাই। সত্যই যাহাতে ভারতকে জঞ্জালহীন করা যায়, সেই চেষ্টা করিতে হইবে। এই গঠনমূলক সহযোগিতাই কাম্য। কিন্তু রাজনৈতিক অস্তিত্বের নিরাপত্তার অভাবে কংগ্রেস সম্ভবত এমনই পীড়িত যে ইতিবাচক চিন্তার অবকাশ নেতাদের নাই। তাঁহারা চর্চিত ক্ষুদ্রতাকে আশ্রয় করিয়া ময়দানে টিকিয়া থাকিতে ব্যস্ত।
কেবল ‘স্বচ্ছ ভারত অভিযান’-এর ন্যায় ‘অরাজনৈতিক’ কর্মসূচিই বা কেন, যাহা চরিত্রগত ভাবে রাজনৈতিক, তাহাতেও সহযোগিতা বিধেয়। দলীয় সমালোচনার মুখে তারুর বলিয়াছেন, গত তিন দশক যাবৎ তিনি ভারতের বহুত্বের প্রবক্তা। বিজেপি-র হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির প্রতি তাঁহার সমর্থন নাই। সেই সমর্থন তারুর বা কংগ্রেসের নিকট প্রত্যাশিতও নহে। কিন্তু, যে নীতিগুলি ভারতের উন্নতির জন্য জরুরি, সেগুলির ক্ষেত্রে রাজনৈতিক রংবিচার কেন? শাসক ও বিরোধীর গঠনমূলক সহযোগিতাই গণতন্ত্রের মূল চালিকাশক্তি। সহযোগিতার অর্থ প্রশ্নহীন সমর্থন নহে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সব সিদ্ধান্ত কংগ্রেসের নিকট গ্রহণযোগ্য না-ই হইতে পারে। কিন্তু কেন তাহা গ্রহণযোগ্য নহে, সেই নীতিতে কী পরিবর্তন প্রয়োজন, তাহা জানানোও বিরোধীদের কাজ। বস্তুত, ‘স্বচ্ছ ভারত অভিযান’-এর ক্ষেত্রে যে ভাবে সকল সরকারি কর্মচারীকে গাঁধীজয়ন্তীর দিন অফিসে আসিতে বাধ্য করা হইয়াছিল, সেই পদ্ধতিটি কংগ্রেসের নিকট অগণতান্ত্রিক ঠেকিতেই পারিত। কিন্তু, তত কথা ভাবিবার অবস্থা কংগ্রেসের নাই। তারুর ব্যতিক্রম হইতে পারেন, তাঁহার দলের সেই সদিচ্ছা নাই।