দার্জিলিং হইতে অনেক দূরে দিল্লিতে মৃত্যুর অনেক আগেই সুবাস ঘিসিঙ্গ ইতিহাস হইয়া গিয়াছিলেন। গোর্খাল্যান্ড আন্দোলনের জনক দীর্ঘকাল যাবত্ পার্বত্য দার্জিলিঙের রাজনীতিতে কোণঠাসা ছিলেন। তাঁহারই এক সময়ের মন্ত্রশিষ্য বিমল গুরুঙ্গ ওই আন্দোলনের রাশ তাঁহার হাত হইতে কাড়িয়া লন। ঘিসিঙ্গের জিএনএলএফ তাহার গণভিত্তি হারায়, বিনিময়ে পুষ্ট হইতে থাকে বিমল গুরুঙ্গের গোর্খা জনমুক্তি মোর্চা। তাহার আন্দোলনের পদ্ধতিও বহুলাংশে ঘিসিঙ্গের পদাঙ্কই অনুসরণ করে। হঠাত্-হঠাত্ দীর্ঘকালব্যাপী অবরোধ, ঘেরাও বা বন্ধ ডাকিয়া পাহাড়কে সমতল হইতে কার্যত বিচ্ছিন্ন করিয়া দেওয়া। ব্যক্তি ঘিসিঙ্গ এই পর্যায়েই পার্বত্য দার্জিলিঙের জনমানস হইতে মুছিয়া যাইতে থাকেন। এখন ব্যক্তি ঘিসিঙ্গ অতীত হইলেন। জীবন নশ্বর।
পশ্চিমবঙ্গের জীবনকাহিনিতে সুবাস ঘিসিঙ্গের পদচিহ্ন নশ্বর নহে। তাহা সুখের কথা নহে, কারণ তাঁহার রাজনীতির পরিণাম রাজ্যের পক্ষে শুভ হয় নাই। কিন্তু ইহা অনস্বীকার্য যে, সুবাস ঘিসিঙ্গই প্রথম রাজনীতিক, যিনি পাহাড়ের মানুষের প্রতি সমতলের শাসকদের অবহেলার কথা জোরের সঙ্গে তুলিয়া ধরেন। প্রতিকারের উপায় হিসাবে স্বতন্ত্র গোর্খা রাজ্যের দাবিও তাঁহারই। এ জন্য তাঁহাকে প্রথমে উপহাস করা হয়, কিন্তু অতি দ্রুত দার্জিলিং তাঁহার সংগঠন জিএনএলএফের পতাকা তুলিয়া লইলে প্রাদেশিক ও কেন্দ্রীয় প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষ নড়িয়া বসিতে বাধ্য হয়। ভুটান, নেপাল, চিন ও বাংলাদেশের মতো দেশগুলির সমীপবর্তী হওয়ায় রণনৈতিক ভাবে গুরুত্বপূর্ণ এই অঞ্চলে যে কোনও বিচ্ছিন্নতাবাদী বা হিংসাত্মক আন্দোলন চলিতে দেওয়া ঝুঁকির কাজ। অতএব কড়া হাতে তাহা মোকাবিলার সিদ্ধান্ত হয়। ঘিসিঙ্গও হিংসার পথেই নিরাপত্তা রক্ষীদের মোকাবিলা করিতে চাহিলে সরকারি দমন নীতি কঠোরতর হয়। পার্বত্য দার্জিলিঙে বহু মানুষের মৃত্যু ঘটে। অবশেষে স্বশাসিত গোর্খা পার্বত্য পরিষদ হাসিল হইলে ঘিসিঙ্গ ক্ষান্ত হন। তাঁহার অনুসৃত পদ্ধতি, বিশেষত অচলাবস্থা সৃষ্টি এবং হিংসার আশ্রয় কখনওই সমর্থনযোগ্য নয়। বস্তুত, এই হিংসা ও রক্তক্ষয় সমতলের সহিত পাহাড়ের দ্বন্দ্বকে আরও সূচিমুখ করিয়াছে, পরস্পরের প্রতি সহিষ্ণুতা, প্রতিপক্ষের দৃষ্টিভঙ্গি উপলব্ধি করার জন্য চেষ্টা চালানো বা ধৈর্য ধরার পরিবর্তে দুই পক্ষের সম্মুখসমরের পটভূমি রচনা করিয়াছে। তাহাতে ক্ষতিও হইয়াছে উভয়েরই।
পশ্চিমবঙ্গে গোর্খাল্যান্ড আন্দোলন রাজ্যের সমূহ ক্ষতি সাধন করিয়াছে। প্রস্তাবিত স্বতন্ত্র গোর্খা রাজ্য সৃষ্টি করিতে এই রাজ্যের বিভাজনও কাম্য নয়। এমনকী দার্জিলিঙের যথার্থ ‘বাসিন্দা’ হিসাবে গোর্খাদের দাবি ঐতিহাসিক মাপকাঠিতে কতটা গ্রহণযোগ্য, তাহা লইয়াও প্রশ্ন থাকিতে পারে। কিন্তু গত তিন দশকে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে জনজাতীয় আত্মমর্যাদার নৈতিকতা বা বৈধতা অতীতের তুলনায় অনেক বেশি স্বীকৃতি অর্জন করিয়াছে, সেই প্রেক্ষিতে দার্জিলিঙের ইতিহাসও বিশেষ তাত্পর্য দাবি করে। স্বাতন্ত্র্যের দাবি নৈতিক হোক বা না হোক, কী ভাবে সেই দাবির রাজনৈতিক মোকাবিলা করা দরকার, তাহা বড় প্রশ্ন হইয়া দাঁড়াইতে পারে। সুবাস ঘিসিঙ্গের বিপথগামী আন্দোলন এই বিষয়ে মূল্যবান শিক্ষা দিয়াছে।