মোহন ভাগবতের বক্তৃতা দূরদর্শনে প্রচারিত হইবার সিদ্ধান্ত লইয়া সমালোচনার ঝড় উঠিয়াছে। কোনও বক্তৃতা টেলিভিশনে দেখানো হইবে কি না, তাহা নির্ভর করিতেছে বক্তৃতাটি কত দূর ‘সংবাদযোগ্য’, তাহার উপরই। মোহন ভাগবত যে দলেই বিরাজ করুন না কেন, গণতান্ত্রিক দেশে তাঁহার মতামত সর্বজনের জ্ঞাতার্থে উল্লিখিত হইবে কি না, তাহা তাঁহার বক্তব্যের প্রাসঙ্গিকতাই বিচার করিবে। এই বার প্রশ্ন, রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের প্রধান যে বক্তব্য পেশ করিয়াছেন, তাহা কি একটি ‘সংবাদ’? ঘটনাচক্র বলিতেছে, হ্যাঁ। কেবল সরকারি চ্যানেল দূরদর্শন নয়, বেসরকারি টিভি চ্যানেলগুলিতেও তাহা শোনা গিয়াছে, কিছু ক্ষেত্রে সরাসরি সম্প্রচারও হইয়াছে। এ কথা সত্য যে সঙ্ঘপ্রধান হিসাবে এই বার্তা তিনি প্রতি বছরই দিয়া থাকেন, এই বারও সেই নিয়মিত কাজটিই করিয়াছেন, তাহার বেশি কিছু নয়। তবে কি না, প্রতি বছরই তো ভারতীয় জনতা পার্টির বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতায় জিতিয়া আসা কেন্দ্রীয় সরকার দিল্লিতে অধিষ্ঠিত থাকে না। এই কারণেই আর এস এস প্রধানের ‘নিয়মিত’ কাজটিরও এ বার কিছু ‘অনিয়মিত’ গুরুত্ব: প্রতি বার কেন্দ্রীয় সরকারের নীতিপ্রণয়নে বা কর্ম-পরিচালনায় সঙ্ঘপ্রধানের বাণীর অভিঘাত এত প্রত্যক্ষ ও প্রবল হইবার সম্ভাবনা থাকে না! দ্বিতীয়ত, তিনি তাঁহার বক্তৃতায় যে ‘উদারতা’র কথা বলিয়াছেন, তাহাও আন্তরিক হউক বা কৌশল হউক সংবাদ হিসাবে তাত্পর্যপূর্ণ। কংগ্রেস বা বামপন্থীদের বুঝিতে হইবে, অনেক সময় ঘটনা তাহার আপাত-তুচ্ছতার আড়ালে গভীর নির্দেশ বহন করিয়া আনে, প্রচারমাধ্যমে তাহা স্বাভাবিক ভাবেই খবর হইয়া যায়।
পরবর্তী প্রশ্ন, যে খবর নিজগুণে খবর, তাহা সরকারি দূরদর্শন চ্যানেল সম্প্রচার করিবে কি না। এ বিষয়ে একটি কথাই বলা যায়। সরকারি অর্থে চালিত হইলেই কোনও প্রতিষ্ঠান সরকারি ধামাধরা হইয়া যায় না। অর্থদায় ছাপাইয়া তাহার নিজের একটি পরিচিতি স্থাপিত হওয়া জরুরি, ইহা যেমন বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে সত্য, টিভি চ্যানেলের ক্ষেত্রেও। ধর্ম-বর্ণ-মত সব কিছুই সেখানে গৌণ, একটিই গুণ মুখ্য: সংবাদ। পোপের সফর বা বেলুড় মঠের পূজার সরাসরি সম্প্রচারও তাই স্বভাবত সংবাদ। দূরদর্শন প্রচারবাণিজ্য করিতেছে, সরকারি চ্যানেল বলিয়া জনসেবা করিতেছে না।
সমস্যাটি আসলে এ দেশে সরকারি চ্যানেলকে কী ভাবে দেখা হয়, তাহার মধ্যেই। অথচ সরকারি চ্যানেল কী ভাবে যোগ্য, দৃপ্ত, নিরপেক্ষ মঞ্চ হইয়া উঠিতে পারে, তাহার নিদর্শন কিন্তু হাতের কাছেই। বিবিসি একটি সরকারি প্রতিষ্ঠান, কিন্তু প্রয়োজন মতো সরকারবিরোধী অবস্থান লইতেও পিছপা নহে। দরকারে সরকারের সমর্থনেও তাহারা ইতস্তত করে না। প্রয়োজন এই নিরপেক্ষ প্রত্যয়ের। এই প্রত্যয় প্রতিষ্ঠানের ভিতর ও বাহির উভয় দিক হইতেই আসা দরকার। চ্যানেলকেও স্পষ্ট, নির্দ্বিধ, সংবাদমুখী হইতে হইবে। সমাজেরও অত আতুপুতু করিলে চলিবে না। সঙ্ঘপ্রধানের বার্তা দূরদর্শনে প্রচার করিলেই যদি দেশের সমাজ সঙ্ঘীভূত হইয়া যায় তবে সে রসাতল দেশের গন্তব্যই ছিল, মানিতে হইবে। সুতরাং, দূরদর্শন যাহা করিয়াছে ঠিকই করিয়াছে, দেখা যাক অন্যান্য ক্ষেত্রেও এই নির্ভীক নিরপেক্ষতা রাখা যায় কি না। সরকারি কাজকর্ম লইয়া সরব তর্কবিতর্ক আয়োজিত হয় কি না। বিলম্বে হইলেও ‘বিবিসি-আয়ন’-এর পথে যাত্রা শুরু হউক।